Friday, July 16, 2021

ঊনজীবনের 'সুগন্ধী ছাই'

ঊনজীবনের 'সুগন্ধী ছাই'

অশোকানন্দ রায়বর্ধন (১৬ জুলাই-২০২১ বজ্রকন্ঠ অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত )

  সব ছন্দপতন মেনে নেয়া যায়না ৷ মেনে নেয়া যায়না অসময়ে চলে যাওয়া ৷ যখন আমাদের বয়সী মানুষেরা চলে গেলে সমাজের তেমন ক্ষতি হয়না ৷ জগৎজীবনে ততটা আলোড়ন তোলেনা ৷ কিন্ত সেসময়ে একেবারে ঝকঝকে তারুণ্যের কালে কিংবা জীবনসীমার প্রথমার্ধ না পেরুতেই জীবননদী পেরিয়ে সুদূরের পথে চলে যাওয়া তীব্র ঝাঁকুনি দেয় সমাজের বুকে ৷ তেমনি চলে যাওয়া সুমিতা ধর বসুঠাকুরের ৷ সুমিতার ৷ কদিন আগে অগ্রজ কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ও আরো কয়েকজনের দেওয়া সোস্যাল মিডিয়ার বার্তায় জেনেছিলাম সে খুব অসুস্থ ৷ কিন্তু সুস্থ হয়ে আর ফিরলনা ৷ রেখে গেল প্রাণপ্রিয় স্বামী ও সন্তানকে ৷ আর বাংলা কবিতার ভুবনে তার কবিতার খাতার খোলা পৃষ্ঠা ৷

    খুব অল্প সময়ের জন্যে সাহিত্যভুবনে  ঝকঝকে উপস্থিতি এই বিদুষী বোনের ৷ এই শতাব্দীর প্রথমদিকে আগরতলা বইমেলায় কবিতাপাঠে বা অন্য কোনো সাহিত্যের আসরে তাঁকে দেখতাম নিজের কবিতটি পড়ার জন্যে দীর্ঘক্ষণ দর্শকাসনে বসে অন্যদের কবিতা শুনতেন ৷ কবিতাপাঠের পরে সাধারণত আর থাকতেননা ৷ সেসময় তিনি হিন্দি কবিতাই পড়তেন বেশির ভাগ ৷ কিন্তু প্রতিভাটিকে ঠিক নজরে পড়ে রাজ্যের অগ্রজ কবি ও সংগঠক পূর্ণেন্দু গুপ্তের ৷ তাঁরই প্রেরণায় ধীরে ধীরে তাঁর কাব্যপ্রতিভা কিরাতভূমির সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাকবিতা বৃহত্তর ভুবনে ছড়িয়ে পড়ে ৷ আজ তাঁর অকাল প্রয়াণে যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই করোনাকালীন সময়েও আন্তর্জালের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে নানা শৈল্পিক আঙ্গিকে, বেদনায় সিক্ত হয়ে ৷ তাতে অনুভব করা যায় তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধ  কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ৷ 
কবিতায়, গানে, আবৃত্তি, সঞ্চালনায়, শিক্ষিকা, সুগৃহিনী হিসেবে এক প্রাণোচ্ছল জীবন ৷ গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর স্বামী করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন ৷ বাড়িতে রেখে অত্যন্ত সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলেছিলেন তাঁকে ৷ সন্তান সোহমকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি ৷ 

প্রথমা, সুগন্ধি ছাই, ঘুমের ভেতর, ছন্দে ছন্দে আসমানী ইত্যাদি পরপর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাঁর ৷ সর্বশেষ 'ঋতুবতী মেঘ' কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় আগরতলার নীহারিকা প্রকাশন থেকে ৷নিজের সংসারের সব কাজ সামলে, সামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করে আপন সন্তানের মতো লালিত হয়েছে তার ম্যাগাজিন 'আকাশের ছাদ' এর প্রতিটি সংখ্যা বহু প্রতিষ্ঠিত ম্যাগাজিন  সম্পাদকদের ঈর্ষার কারণ ছিল বিষয়বস্তু নির্বাচনে, নির্মানশৈলীতে ৷ মলাট উন্মোচনের ক্ষেত্রেও তিনি অত্যন্ত যত্ন ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রাখতেন তিনি ৷ একা হাতে দক্ষ রাঁধুনির মতো পরিপাটি করে হলভাড়া থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্যন্ত সুশৃঙ্খলার ছাপ রাখতেন ৷ কবিতার প্রতি, সাহিত্যের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা, নিবিড় মমত্ববোধ না থাকলে এমনটা সম্ভব নয় ৷
কবিতায়ও তিনি তেমনি লেখেন—
'কার লাগি বাজি রাখে প্রাণ/বাকিটা জীবন সুখের সুখ/আর কবিতা তোর শরীরে/রঙ এঁকে আজ ঢাকি মুখ
( ওগো কবিতা-সুমিতা ধর বসুঠাকুর) ৷ সুমিতা ধরবসুঠাকুর যাপনে যেমন ছিলেন সোজাসাপ্টা মনের মানুষ তেমনি তাঁর কবিতায়ও সহজ সরল শব্দে তার প্রকাশ ঘটে—'কলমের বুকে ঝুলছে রাজনীতির লকেট/কি বিক্রি করে জীবন কিনব?এক বাজারে সব কিছু বন্ধক/নিস্তব্ধতা মেরে ফেলেছে শব্দের ধার,/নিজেদের মধ্যে বিভেদহীন গীতা কোরান/কখনো উল্টে দেখেনি পৃষ্ঠার ভূমিকা রক্তশোষী/উল্কি ওড়ায় হাওয়ার গায়ে, আগুন ছয়লাপ/চল সাজাই বিপন্ন অক্ষর হে ব্রহ্মচারী' ( অক্ষর কান্না) ৷ কবিতার প্রতি প্রগাঢ় প্রণয় অকপটে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতায়-'তোমার গভীর ঘুমকে যদি টেনি হিঁচড়ে নিয়ে আসি আমার কাছে,/জিদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে কি নরম শয্যায়!/দেখ, কেমন গুছিয়ে দিচ্ছি তোমার আলুথালু মন ৷/একটু একটু করে উপোসি বেলা ভরে গেল যত্নের রঙ দিতে দিতে/তুমি কিন্তু রেখে যেও চিরকুটের সবুজ উত্তরমালা' ৷ ( ঋতুমতী মেঘ) ৷ অথবা-'মরণ যখন হাওয়ায় ওড়ে, পরায় শেকল পায়ে/তখন তুমি সঙ্গোপনে প্রেম রাখ এই গায়ে'৷ কর্মচঞ্চলা অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর কবি নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদসীন বলেই কী লেখেন-'এখানে মন মৃত, প্রেম অনন্ত শয্যায়/যার সাথে রাত হেসে ওঠে রোজ/সেই বাসরের প্রথম ফুলে ইঁটের কবজ/সিঁথির লাল  নাকের ডগায় ঘাম মুছে জ্বলে ওঠে যে বাতিদান/তার ঝিরঝিরে মোম বর্ষায়,/সুরক্ষিত হতে ভুলে যায় মেঘ ( হারিয়ে গেলে-সমিতা ধরবসুঠাকুর) ৷ 
আমি আমার এই বয়সে ত্রিপুরার সাহিত্যাকাশে অনেক গুণীজনের সান্নিধ্যে এসেছি ৷ এমন বহুভাষায় পারদর্শী, এত প্রতিভা,এমন প্রাণোচ্ছল আর একজনও দেখিনি ৷ আমার জানার বহর কম হতে পারে ৷ তবুও বলছি কথাটা ৷ বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, মালয়ালম ইত্যাদি ভাষায় সমান বিচরণ তাঁর ৷ বাংলা কবিতা ভূমন্ডলে তিনি যেমন পরিচিত মুখ ৷ তেমনি হিন্দি কবিতায়ও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী ৷ সেই আকাশেও তিনি উজ্জ্বল নক্ষত্র ৷ অনুবাদক হিসাবেও তাঁর খ্যাতি ছিল ৷ এই প্রতিভাময়ীর অকালে চলে যাওয়া আমাদের বিরাট ক্ষতি ৷

   কবছর আগে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি ভাষাবিভাগ আয়োজিত এক সেমিনারে সুমিতার সঙ্গে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার ৷ দেশের সব অঞ্চলের হিন্দিভাষার কবিরা তাঁকে চেনে ৷ তাঁর কবিতাকেও জানে ৷ হোয়াটস অ্যাপএ বাংলা हिन्दि সাহিত্যচর্চা নামে তাঁর সৃষ্ট একটা গ্রুপ আজও সচল ৷ বহুভাষিক সঙ্গীতশিল্পীও ছিলেন সুমিতা ৷ তার স্বাদ অনেকেই পেয়েছেন ৷ 

   লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক সুমিতা ৷ তিনসুকিয়া, গুয়াহাটি, আগরতলা সর্বত্রই উপস্থিত ছিলেন তিনি ৷ লিটল ম্যাগ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ৷ লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনগুলোতে বর্ষিয়ান সন্দীপদার শরীরের প্রতি খুব লক্ষ্য রাখতেন সুমিতা ৷ গত নবছর ধরে প্রকাশ করে চলছিলেন লিটল ম্যাগাজিন "'আকাশের ছাদ' ৷ এই ম্যাগাজিনটি প্রকাশের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই তাঁকে সাহায্য করে গেছেন রাজ্যের আর একজন প্রাণস্পন্দনে ভরপুর কবি ৷ সুমিতা তাঁর কাগজটি প্রকাশের ব্যাপারে এতো যত্নশীল ছিলেন যে তাকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার জন্যে অনেকের কাছে পরামর্শ ৷ আমি আগরতলায় থাকাকালীন তিনি কয়েকবার আমার ভাড়া বাসায় এসে লেখা নিয়ে গেছেন ৷ কাগজের প্রিন্ট নিয়ে এসে প্রুফ দেখানোসহ টুকটাক গুছানোর কাজ করিয়ে নিয়ে গেছেন ৷ আর ছিল সবার সঙ্গে মেশার বিরল দক্ষতা ৷ অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধা ৷ অনুজদের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ তাঁর যাপনের সঙ্গী ছিল ৷ যখন যেখানে যেতেন হৈ চৈ, গান, কবিতায় মাতিয়ে রাখতেন ৷ অপরিচিতজনের সাথে আমার পরিচয় দিতেন অশোকানন্দ দাদা বলে ৷

বইমেলার লিটল ম্যাগ প্যাভেলিয়ন সুমিতাকে ছাড়া যেন অপূর্ণ থাকত ৷ একদিকে যক্ষের ধন আগলে থাকতেন কবি নকুল রায় ৷ অন্যদিকে তুমুল কবিতাপাঠ, আড্ডা, কোনো কাগজের নতুন সংখ্যা প্রকাশের তোড়জোড়, হাতে হাতে কাগজ তুলে দিয়ে মলাট উন্মোচন, একযোগে ছবি তোলা, সবেতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সুমিতার ৷ সুমিতা সাজতে ভালোবাসতেন আর সবাইকে নিয়ে ছবি তোলায় তাঁর একটা বিশেষ   ভূমিকা ছিল ৷ বইমেলা, কোনো সেমিনার, লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনে আমার শরীরের খোঁজ নিয়েছেন প্রতিনিয়ত ৷ আমার পরিবারের অন্য সদস্যরাও আজ মর্মাহত ৷  প্রায়শই আমরা কবিতায় কবিতায় চাপান-উতোর খেলা খেলতাম অবসরে ৷ নিজেই আজ ছন্দের জাল কেটে বেরিয়ে গেলেন সুমিতা ৷

    একান্ত শিবভক্ত সুমিতা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি শিবমন্দির দর্শন করেছে ৷ কথা ছিল প্যানডেমিক শেষ হলে আমার এখানে আসবে ৷ বউদির সঙ্গে ঝগড়া করবেন ৷ আমাদের নিয়ে জলেফা শিববাড়ি দর্শনে যাবেন ৷ কবি বিজন বসুকে ডেকে নেবেন ৷ এরপর কবি সাচিরাম মানিকের আমলিঘাটের বাড়িতে যাবেন ৷ সেখানকার শিবমন্দিরটি দর্শন করবেন ৷ 
 
    হলনা কিছুই ৷ সাধ না মিটিল আশা না পুরিল ৷ আকাশের ছাদের বাসিন্দা হয়ে গেল সুমিতা ৷ বড়ো ঊণবেলায় ৷ সুমিতা, বোন আমার! আকাশের ছাদময় ক্যানভাসে দেখছি তোমার শিবসুন্দর মুখটি ৷ আর গুনগুন করছি তোমার অমোঘ উচ্চারণ—'একটু সরলতা রেখে গেলাম কুড়িয়ে নিও তাপ বেলা' ৷ ( বিকেল)
সেদেশেও ভালো থেকো সুমিতা ৷

No comments:

Post a Comment