Friday, March 3, 2023

ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার উদ্ভবকাল, রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও ধারাবাহিকতা



ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার উদ্ভবকাল, রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও ধারাবাহিকতা


 ত্রিপুরার নৃত্যচর্চার উদ্ভব :

পূর্বেই বলা হয়েছে ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় সংগীত এবং নৃত্যচর্চা ইত্যাদি সবই ত্রিপুরার রাজপুরুষদের হাতে বিকশিত হয়েছে । শুধু শাস্ত্রীয় বা উপশাস্ত্রীয় নয়, এমনকি লোকগান, বাদ্যযন্ত্র, সংগীত শাস্ত্রের চর্চা ত্রিপুরায় এই রাজপুরুষদের কল্যাণেই হয়েছিল ।

ত্রিপুরার সুশীলসমাজের সংস্কৃতি চর্চা তথা নৃত্যগীত, নাটক, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদির যে স্বরূপ আজ আমরা দেখি তার সুতিকাগৃহ ছিল ত্রিপুরার রাজবাড়ি । ত্রিপুরার উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চাই হোক,  বাউল-ভাটিয়ালি হোক রাজ পরিবারের হাত ধরেই তা জনসমক্ষে আসে । নৃত্য, বাদ্য, নাটক সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি এমন কিছু বাকি নেই যা রাজ পরিবারে চর্চিত হয়নি । নৃত্যের ক্ষেত্রে যদিও মনিপুরী নাচের প্রভাবেই ছিল সম্পূর্ণরূপে । এর কারণ আগে আলোচনাও করা হয়েছে । তবু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা কারণে অকারণেও রাজবাড়িতে বাইরে থেকে শিল্পীরা আসতেন । রাজ আতিথ্যে সেখানে থাকতেন । নৃত্যগীতের আসর বসত প্রায়শই । বিখ্যাত কত্থক শিল্পী কুলন্দর বক্স, অলকানন্দা, কনিজ, চাঁদাবাইজি, ইমামি বাইজি, গহরজান, মালেকজান, প্রমুখ সেই আসরের অংশ গ্রহণ করেছিলেন । বড় বড় ধ্রুপদিয়া, সরোদিয়া, সেতারশিল্পীদের এখানে নিত্য আনাগোনা ছিল । সবচেয়ে বড় কথা মহারাজারা নিজেরাও এসব কিছুতে বিশেষ পারঙ্গম ছিলেন । ফলেই এগুলির প্রচার ও প্রসারে তাঁদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে । তাঁরা শুরু করে গিয়েছিলেন বলেই আজ আগরতলাকে ত্রিপুরাবাসী 'সংস্কৃতির শহর' বলতে গর্ব অনুভব করেন । এ ব্যাপারে রাজপুরুষদের দান অনস্বীকার্য । ছোট্ট একটি পার্বত্য রাজ্য অথচ এর আকাশ বাতাস চিরকাল সুরে ছন্দে বর্ণে গানে তালে লয়ে মুখরিত । এখানকার সুউচ্চ শিল্প বোধ সম্পন্ন রাজারা ছিলেন গভীর সংস্কৃতি অনুরাগী । যতটুকু জানা যায়, ত্রিপুরা রাজন্যাকূলে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা ও প্রসারের জন্য ও প্রজাদের নৃত্য ও সংগীত শিক্ষার জন্য প্রথম উদ‍্যোগ নেন মহারাজ ধন্য মানিক্য ( ১৪৯০–১৫২৯ ) । তিনি সংগীত শিক্ষা দেওয়ার জন্য 'ত্রিহুত দেশ' (মিথিলা ) ও বঙ্গদেশ থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদদের আমন্ত্রণ করে এনে তৎকালীন রাজপ্রাসাদ সংগীতমুখর করে তুলেছিলেন এবং তাঁদের স্থায়ীভাবে ত্রিপুরায় বসবাসেরও ব্যবস্থা করেছিলেন । ত্রিপুরার প্রাচীন রাজমালায় এর প্রামাণ্য তথ্য থেকে জ্ঞাত হওয়া যায়–
    
    ত্রিহুত দেশ হইতে নৃত্যগীত আনি ।
    রাজাতে শেখায় গীত নৃত্য নৃপমণি ।।
    ত্রিপুর সকলে ক্রমে সেই গীত গায় ।
    ছাগ অন্তে তারযন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।।

রাজমালার এই তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় নৃত্যের ও প্রচলন হয়েছিল এই ত্রিপুরায় । পরবর্তী মানিক‍্য রাজাদের অনেকেই বহির্রাজ্যের নৃত্য ও সঙ্গীত শিল্পীদের তাদের রাজসভায় আমন্ত্রণ করে এনেছেন তা আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি ।

  পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে মনিপুরী সংগীত-নৃত্যের ধারা ত্রিপুরায় অনুপ্রবেশ ঘটে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে । এরপর ত্রিপুরার তৎকালীন রাজন্য বর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই সমস্ত সংগীতের ভাব, রসধারা, সুরধ্বনি ত্রিপুরার মহারাজদের চর্চিত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে মিলেমিশে অন্য এক ঘরানার রূপ নেয় । এই অনুকরণ ঘটে মূলত মহারাজ বীরচন্দ্র দ্বারা বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ছন্দে রচিত গীতগুলিতে । তাঁর শ্রেষ্ঠ গীতগুলি হোরি বা হোলি গানের উপরে শুধু সীমাবদ্ধ ছিল না । বিভিন্ন কীর্তন ভজন নটসঙ্গীতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল ।

ত্রিপুরার মহারাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃজনী সংগীত রচয়িতা ও সুরকার অনিলকৃষ্ণ দেববর্মা ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা ও গুণী । তাঁর 'নাদলিপি' নামে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয়সংগীতের বিভিন্ন রাগ রাগিনীর উপর রচিত ( ১১শ খন্ড )–

  হেরিয়া বিলাস রসে খেলত কানাইয়া,
ঝোড়ত আবির কুমকুম রাইমুখ হেরিয়া ।    
                                                                                         

ত্রিপুরার সঙ্গীত ও নৃত্যচর্চায় বীরচন্দ্র মানিক্য ও তাঁর উত্তরসূরীদের  পৃষ্ঠপোষকতা । 


রাজা সকল দেশেই শিল্পসাহিত সংস্কৃতি চর্চার কিছু না কিছু পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন । কিন্তু শিল্পের অন্বিষ্ট সাধনায় সমর্পিত প্রাণ একের পর এক রাজ পুরুষের শান্ত, স্নিগ্ধ মুখমন্ডল এই ত্রিপুরাকে গৌরবান্বিত করেছে বারবার । সৃষ্টি ও পরিচর্যার অনুপম তাগিদে । এ রাজ্যের রাজপুরুষেরা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন নিভৃত শিল্পচর্চার অতুলনীয় সাধনায় । তারা কাব্য লিখেছেন, গান গেয়েছেন, ছবি এঁকেছেন, নাটক লিখেছেন, আবহসংগীত রচনা করেছেন, নৃত্যশিল্পের প্রসারে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছেন ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছেন অবিস্মরণীয় পালঙ্গমতায় । সৃষ্টিসুখের এই ফল্গুধারা সেদিন গোটা রাজঅন্তঃপুর থেকে সাধারণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল । আজও ত্রিপুরার পাহাড় কন্দর থেকে রাজধানী আগরতলা পর্যন্ত এমন কোন আদিবাসী পরিবার পাওয়া যাবে না যেখানে বংশ-পরম্পরায় কোন না কোন শিল্পের চলমান ধারা অনুপস্থিত ।

ত্রিপুরা রাজপ্রাসাদে চর্চিত ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীত বিভিন্ন সময়ে রাজপ্রাসাদ থেকে সাধারণের মধ্যে কিভাবে পৌঁছাত ও তার সঠিক মূল্যায়নে কিভাবে রাজানুকুলের পৃষ্ঠপোষকতা পেত  এ সম্বন্ধে কিছু প্রামাণিক তথ্যের উপর আলোকপাত করা যেতে পারে । রাজন্যশাসিত ত্রিপুরায় বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তার কারণে রাজধানী রাঙ্গামাটি ( উদয়পুর ), অমরপুর, কৈলাগড়,( কসবা ), পুরাতন আগরতলা প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করেছিলেন ত্রিপুরার রাজন্যবর্গ । এ সময়ে দিল্লি-ই সুবাণী মুঘলদের রাজত্ব । এদের রাজদরবারে তৎকালীন যুগে ভারতবিখ্যাত হিন্দু অথবা মুসলমান শাস্ত্রীয়সংগীতের ওস্তাদের সঙ্গে ত্রিপুরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল । সেই সূত্রে ত্রিপুরার রাজদরবার এদের পাদস্পর্শে ধন্য হয়ে যেত ।

উদয়পুর থেকে মহারাজ কৃষ্ণমানিক্য ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যপাট পুরাতন আগরতলায় স্থানান্তরিত করে নিয়ে আসেন । ১৮৩০ থেকে ১৮৪৯ সালে মহারাজ কৃষ্ণকিশোর মানিক‍্যের শাসনকালে নতুন রাজধানী পত্তন হয় আগরতলায় । কৃষ্ণকিশোর  ত্রিপুরার ইতিহাসে আধুনিক যুগের প্রবর্তক বলে পরিচিত । তিনি মহারাজ বীরচন্দ্র মানিকের পিতা । নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণ পর্ব শেষ হবার পর এই দরবার কক্ষে নিয়মিত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর বসত । ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ ঈশানচন্দ্র মানিক্য পুরাতন আগরতলা রাজধানীতে রাজ সিংহাসনে সমাসীন । রাজ্যের ঠুংরী গায়কেরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন । সেই সময়কার বিখ্যাত চিত্রকর 'আলম কারিগরে'র আঁকা একটি দুর্লভ চিত্র একদা উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের শোভা বর্ধন করত । এই চিত্রে দেখা যায় পুরাতন রাজপ্রাসাদের নাচ দরবারে মহারাজ ঈশানচন্দ্র তার সভাসদ নিয়ে বসে আছেন ও জনৈক্য নর্তকী নৃত্য করছেন । চিত্রটি খুবই সজীব ও এর ঐতিহাসিক মূল্য ছিল অপরিসীম । ত্রিপুরা রাজন‍্যবর্গ ও এদের পরিবার-পরিজনবর্গ প্রত্যেকেই ছিলেন সুদক্ষ সংগীত,নৃত‍্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক । ত্রিপুরার পার্শ্ববর্তী রাজ্য ছিল মনিপুর তথা মেখলি রাজ্য । সেখানে 'মৈতেই' ভাষায় শাস্ত্রীয় সংগীতের ও নৃত্যের চর্চা হত । ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ পাম হৈবার পুত্র চিং-থুম-খম্বা তথা ভাগ্যচন্দ্র সিংহ কন্যা হরিশ্বরীর সঙ্গে তৎকালীন ত্রিপুরার মহারাজ দ্বিতীয় রাজধর মানিকের বিবাহের মধ্য দিয়ে পুরাতন রাজধানী আগরতলায় মনিপুরী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে শুরু করে । মনিপুরী সংগীতে বেশিরভাগ বৈষ্ণবীয়  ব্রজবুলি ছন্দে রচিত সংগীত যা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের রসধারায় সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ । পাশাপাশি এই সময়ে মনিপুরী নৃত্যের ধারাটিও ত্রিপুরার রাজ অন্তঃপুরে প্রবেশ করে । আমরা  সকলে জানি, ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য ধারার অন্যতম হিসেবে মনিপুরী নৃত্য আজ সারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু মনিপুরী নৃত্যশিল্পের এই বিশ্বজোড়া স্বীকৃতির পেছনে এই ক্ষুদ্র ত্রিপুরা রাজ্যের বিশেষ অবদান রয়েছে তা আমরা অনেকেই জানিনা । ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন ষষ্ঠবারের জন্য ত্রিপুরায় আসেন তখন মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরীর বাড়িতে ওঠেন । কবির সম্মানে মনিপুরী রাস নৃত্যের আয়োজন করা হয় । রবীন্দ্রনাথ মণিপুরী নৃত্যের বিশেষ লাবণ্যময়তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান ও শান্তিনিকেতনে মনিপুরী চর্চার উদ্যোগ নেন । এই বিষয়ে বিস্তারিত পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা যাবে ।

আজ থেকে দেড়শ বছরের বেশি সময়ে তথা ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) খ্রিস্টাব্দ মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য ছিলেন অসাধারণ সঙ্গীত জ্ঞানী । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ছিল তার অদ্ভুত ব্যুৎপত্তি । বস্তুত বীরচন্দ্রের সময়ে রাজনীতি সমাজনীতি ও শিল্প সংস্কৃতির চর্চা ও অনুশীলনে ভারতীয় চিন্তা চেতনার সঙ্গে পশ্চিমী প্রশাসনিক আইন-কানুন পুরনো রীতিনীতির সংস্কার ইত্যাদির কাজ শুরু হয় । পশ্চিমী ধ্যান ধারণায় দেশীয় সম্পদ যাতে অবহেলিত ও বিলুপ্ত না হয় সেদিকেও গভীর নজর ছিল মহারাজ বীরচন্দ্রের ।  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ছিল তাঁর অদ্ভুত দক্ষতা । এঁর সাহচর্যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসেছেন কয়েকবার । বীরচন্দ্রের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ দুবার তাঁর সঙ্গে কার্শিয়াং ভ্রমনের সঙ্গী হয়েছিলেন । সঙ্গে ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন । প্রথমবার ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয়বার ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে । ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক জীবনে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব এক গভীর দ্যোতনার সূচক । মহারাজ বীরচন্দ্রের দূরদৃষ্টি প্রতিভা সংস্কৃতি শিল্প ও সাহিত্যের যে বীজ একদা প্রোথিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সখ্যতা ও তার প্রত্যক্ষ সাহচর্যে। এই বীজ বিরাট মহীরুহতে পরিণত হয়ে ত্রিপুরায় সুসংস্কৃতির বাতাবরণ বইতে সাহায্য করেছিল । পরবর্তীকালে রবীন্দ্র প্রভাব যতটা বিস্তার লাভ করেছিল এখানে, তার তোরণ উন্মুক্ত করেছিলেন মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য । কুড়ি একুশ বছরের অখ্যাত এক তরুণ কবি তখন রবীন্দ্রনাথ । তাঁর ভাবি কালের সৃষ্টি প্রতিভার সন্ধান দেশবাসী তখনও পায়নি । সেই সময় রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে বিমুগ্ধ বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছে তার দূত হিসাবে পাঠালেন সে সময়ের প্রখ্যাত দার্শনিক রাধারমন ঘোষকে । জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে কবিকে অভিনন্দন জানান তিনি । বৈষ্ণব দার্শনিক রাধারমন ঘোষ যার শাস্ত্রজ্ঞানে রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে কর্নেল মহিম ঠাকুর তার এক রচনায় উল্লেখ করেছেন । কবি ও গীতিকার মদন মিত্র এরা ছিলেন বীরচন্দ্রের নিত্যসঙ্গী ।
বীরচন্দ্রের আমলে ত্রিপুরায় যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম নাম করতে হয় যদুনাথ ভট্টাচার্যের, যিনি 'যদুভট্ট' নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন । বর্ধমানের বনবিষ্ণুপুরে ছিল তার বাড়ি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় যদুভট্টের নিকট সংগীতশিক্ষা করতেন । মহারাজ বীরচন্দ্রের সংস্রবে এসেই যদুভট্টের প্রতিভা বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ পায়। যার ফলে পরবর্তীকালে তিনি প্রসিদ্ধ গায়ক, সংগীত রচয়িতা ও বাদক হিসেবে খ্যাতির উচ্চশিখরে  আরোহন করতে পেরেছিলেন । যদুভট্টের গানে মুগ্ধ হয়ে মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য তাঁকে 'তানরাজ' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন ।
 সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা রুদ্রবীণার উল্লেখ দেখি । কাবুল দেশের ভাষায় রুদ্রবীণাই 'রবাব' । তানসেনের বংশধর কাশেম আলী ছিলেন সেসময়ের ভারতের শ্রেষ্ঠ রবাব বাদক । প্রথম জীবনে কাশেম আলী রামপুরের রাজার ও নেপালের রাজার দরবারে ছিলেন । পরে বীরচন্দ্র মানিক্যের সময় ত্রিপুরার দরবারে আসেন । তিনি ভালো সুরধান ও সুরশৃঙ্গার বাজাতে পারতেন । পাখোয়াজ ও তবলাবাদক পঞ্চানন মিত্র ছিলেন মহারাজার প্রাইভেট সেক্রেটারি । সঙ্গীতশাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের কথা জেনে বীরচন্দ্র কেশব মিত্রকে আগরতলায় নিয়ে আসেন । তিনি পরবর্তীকালে বীরচন্দ্রের জটিল রাজকার্যের সহায়কও হয়েছিলেন । রাজকুমারদের শিক্ষক হিসেবে আগরতলা এসেছিলেন ক্ষেত্রমোহন বসু । সুগায়ক ক্ষেত্র মোহন বসু ভালো ধ্রুপদী সংগীত গাইতে পারতেন । কাশ্মীরবাসী  কুলন্দর বক্স ভালো নৃত্য জানতেন । তাঁর নৃত্যের বিশেষত্ব হলো যেকোনো সংগীতকে নৃত্যের মাধ্যমে ভাবের দ্বারা প্রকাশ করতে পারতেন । মহারাজ বীরচন্দ্র তাকে 'কত্থক' উপাধি দেন । এ সময় বীরচন্দ্রের সভায় একে একে স্থান পেয়েছিলেন গোয়ালিয়র রাজ্যের সুরশৃঙ্গার ও এসরাজ বাদক হায়দার খাঁ, মনোহর শাহী সংগীতজ্ঞ প্রতাপচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ঢাকার পাখোয়াজ বিশারদ রামকুমার বসাক, বর্ধমানের বেহালা ওস্তাদ হরিশচন্দ্র পাগলা, সেতার ও সুরধান বিশারদ নিশার হোসেন ও নবীন গোস্বামী গায়ক, ভোলানাথ চক্রবর্তী । সাধু তবলচি তবলা বাজাতেন বীরচন্দ্রের সভায় । ইমামি বাইজি ও চাঁদাবাইজি দীর্ঘকাল বীরচন্দ্রের রাজসভায় সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন । ইমামি বাইজি লখনৌ শহর থেকে এসেছিলেন আর বেনারস থেকে এসেছিলেন চাঁদা বাইজি । এছাড়াও ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ মদনমোহন মিত্র, সুপ্রসিদ্ধ বীণাবাদক নবীনচাঁদ গোস্বামী,বেহালাবাদক হরিদাস প্রমুখ দিকপালগণ । বৈষ্ণব সাহিত্য ও শাস্ত্রীয় সংগীতে তাঁর বৈদগ্ধ যেমন  ছিল তেমনি অন্যদিকে ক্যামেরায় ও ক্যানভাসেও তিনি ছিলেন অতুলনীয় শিল্পী । তাঁর অপূর্ব সৃষ্টির খ্যাতি তখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল । সুদূর ফরাসি ও আমেরিকার পত্রপত্রিকায় তার শিল্পকৃতি সুউচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল । তাঁর বৈদগ্ধ্যে মুগ্ধ হয়ে দেশ-বিদেশের গুণী শিল্পীরা ত্রিপুরার রাজসভায় স্বেচ্ছায় সভাসদ এর আসন গ্রহণ করেছিলেন । এমনকি সুদূর ফরাসি দেশ থেকে  Apollonius  নামে এক আলোকচিত্র শিল্পী বীরচন্দ্রের রাজ দরবারে সভাসদের পদ গ্রহণ করেছিলেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই কেননা তার দৃষ্টি ছিল সুদূরগামী । সেকালের এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র বর্ণময় এক রাজ্যের রাজসভা বিভিন্ন মেধাবী ও প্রখ্যাত ব্যক্তিদের কি সম্পদ দিয়ে আকর্ষণ করেছিল সেটা আজও বিস্ময়ের বিষয় । ত্রিপুরার সংস্কৃতি ইতিহাস এইসব গুণীজনের অবদানে আলোক উজ্জ্বল হয়ে আছে ।

ত্রিপুরার সঙ্গে মনিপুরী রাজ পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক হওয়ার ফলে মনিপুরী সংস্কৃতি ও বৈষ্ণবধর্মের বিকাশ রাজ অন্তঃপুরেও ঘটেছিল । বীরচন্দ্রের মরমী কাব্যগ্রন্থ 'ঝুলন' ও 'হোরি' ইত্যাদিতেও তার ছাপ ধরা পড়েছে । তাছাড়া তাঁর অজস্র পদাবলীসংগীতেও বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব রয়েছে । বীরচন্দ্রমানিক্য তাঁর রচিত খেয়াল ও কীর্তনাঙ্গের গানগুলির সঙ্গে অন্তঃপুরের মহিলাদের নিয়ে নৃত্যের তালিম দিতেন । যেহেতু মহিলাদের অনেকেই ছিলেন বিবাহসূত্রে মণিপুর থেকে আগত । ফলে তাদের নৃত্যে মনিপুরী নৃত্য প্রাধান্য পেত  ।

 বীরচন্দ্রের পরবর্তীকালের তিন রাজা রাধাকিশোর, বীরেন্দ্রকিশোর ও বীরবিক্রমের আমলেও এই সুললিত সংস্কৃতির ধারা বয়ে চলেছিলেন ত্রিপুরার রাজারা । স্বয়ং বিশ্ববিশ্রুত শিল্পী বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে ক্ষান্ত হননি । নিজেদের জীবনকেও উৎসর্গ করেছেন শিল্পচর্চার সুউচ্চ সাধনায় । 

বীরচন্দ্রের পুত্র মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য সঙ্গীত ও সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন । ১৮৭৬ সালে যুবরাজ থাকাকালীন সময়ে 'বার্ষিকী' নামে এক সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন সেখানে তাঁর বাংলাভাষায় সমৃদ্ধ রচনার পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর নির্দেশনাতেই 'শিলালিপি সংগ্রহ' ও 'বৃহন্নারদীয় পুরাণে'র বঙ্গানুবাদ করা হয় । মহারাজ রাধাকিশোর মানিক্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সখ্যতা ছিল তা সর্বজনবিদিত । রাধাকিশোর মানিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আগরতলায় আসেন । সেদিনের তারিখ ছিল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের শ্রীপঞ্চমী দিন । সেবার তিনি রাজঅতিথি হিসেবে কর্ণেল মহিম ঠাকুরের বাড়িতে অবস্থান করেন । যেহেতু রাজপ্রাসাদ তখনো সম্পূর্ণ নির্মিত হয়নি । কবিই সেই সময়কার স্বনামখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে রাধাকিশোরের পরিচয় করিয়ে দেন । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্যার আশুতোষ চৌধুরী, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, মহারাজা যতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্র নারায়ণ, স্যার সত্যেন্দ্র প্রসাদ সিংহ, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, স্যার টি এন পালিত, রাসবিহারী ঘোষ, দ্বারকানাথ চক্রবর্তী । আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নিজস্ব বিজ্ঞান ভবন স্থাপনকালে রাধাকিশোর যে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া রাজর্ষির মৃত্যুর আগে কেউ তা জানতে পারেনি ।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি পাঠে জানা যায়– ত্রিপুরার স্বর্গীয় নৃপতি রাধাকিশোর মানিক্য  বাহাদুর জ্যোতিবাবুকে সংগীত বিষয়ক এখানে মাসিক পত্র সম্পাদন করতে অনুরোধ করেছিলেন ।

মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর তৈল মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিল্প রীতিতে আঁকা একাধিক শিল্পরীতি রেখে গেছেন । সংগীত ও যন্ত্রশাস্ত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ ব্যুৎপত্তি । মনিপুরী খোল বাজনায় সে যুগে তার জুড়ি পাওয়া ভার । সেতারও এস্রাজ বাজানোয় তিনি ছিলেন দক্ষ ।

উত্তরাধিকার সূত্রে মহারাজ বীরবিক্রমও অশেষ গুণসম্পন্ন সংগীতানুরাগী ও স্বয়ং 
স্রষ্টা । তিনি একাধিক নাটক রচনা করেন ও নিজের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ করেন । ১৯৩৪ সালে কলকাতার ত্রিপুরা হাউসে তার রচিত নাটক 'রাধাকৃষ্ণের লীলা বিলাস' সাড়ম্বরে অভিনীত হয় ও গুণীজনের প্রশংসা লাভ করে । হিন্দু মার্গ সংগীতে তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর আমরা পাই তার রচিত 'হোলি' গ্রন্থে–

            চমকন লাগে তেরি বিন্দিয়া সেঁইয়া, 
            উড়ত অম্বর লালে বাদর,
           বিজুরি চমকে তেরী বিন্দিয়া, সেঁইয়া
           ঘটঘন গজরত দফা ডাম্বর,
          বরখে বারি পিচকারি রাঙ্গিয়া, সেঁইয়া ।

সেতার ও এস্রাজে পিতা বীরেন্দ্রকিশোরের মতো তাঁরও ছিল অপূর্ব দক্ষতা । গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর বাজনার রেকর্ড করেছিল । কিন্তু শত অনুরোধেও তিনি তা বাজারে বিক্রি করার অনুমতি দেননি ।

মহারাজা বীরচন্দ্রের প্রযত্নে ধ্রুপদী চেতনার মধ্যে খেয়াল অঙ্গে কাব্যের ভাব ও লালিতে যে কীর্তন চর্চার ধারাবাহিকতা একটা সময় প্রচলিত ছিল তা পরবর্তী সময়ে উপজাতীয় সংগীত সংস্কৃতির উত্তরণেও প্রয়াসী হয় । শ্যামা সংগীত, ভজন ও পল্লীগীতির প্রতি ব্যাপক হারে মনোযোগ লক্ষ্য করা যায় পরবর্তীকালে । পল্লীগীতির  কদর অবশ্য রাজন্য আমলেও ছিল বিশেষত বাংলা ভাটিয়ালি গানের । রাজঅন্তঃপুরে তার প্রবেশ ঘটেছিল মহারাজা বীরবিক্রমের অনুরাগে । তাঁর একটি গান, 'নতুন বন্ধু, পুরান বন্ধুর প্রেম কি তুমি জানো না'— হয়তো আজ আর কারো স্মৃতিতে বেঁচে নেই ।

ত্রিপুরার রাজপুরুষদের এই শিল্পসৌন্দর্যবোধ ও গুনগ্রাহীতার ধারা আমরা  নিরন্তর প্রবহমান দেখি আধুনিক কালেও— মহারাজ বীরচন্দ্র থেকে বীর বিক্রম কিশোর অবধি এরা প্রত্যেকেই যে শুধু শিল্পরসপিপাসু ছিলেন তা নয় নিজেরাও বিভিন্ন অঙ্গনে ছিলেন বিস্ময়কর স্রষ্টা ।

ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা গ্রহণের জন্য পুলিণ দেববর্মা, তারাপদ রায় উত্তরপ্রদেশের লখনৌ ম্যারিস সংগীত মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে পরবর্তী জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন । এছাড়া মহারাজ কুমারগণ, মহেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মা, ব্রজবিহারী দেববর্মা ( লেবুকর্তা ), হেমন্ত কিশোর দেববর্মা, নরেন্দ্র দেববর্মা, প্রমুখরা নিজ নিজ সঙ্গীত জগতে যথেষ্ট বুৎপত্তি সম্পন্ন মননশীলতার পরিচয় রেখে গেছেন । রাজন্যবর্গের যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসারে ত্রিপুরার একদা প্রাতস্মরণীয় প্রবীর দেববর্মা, ( কর্তা ), ঠাকুর বংশীয় কৃষ্ণজিৎ দেববর্মা, বারীন্দ্র দেববর্মা, হিরু দেববর্মা, হিরন দেববর্মা, নারায়ন দেববর্মা, শাস্ত্রীয় সংগীতে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন । শ্রদ্ধেয় পন্ডিত রবি নাগ মূলত মহারাজ কুমার মহেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মার আলয়ে থেকে ও শচীন দেববর্মার স্নেহ পরশে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের যথার্থ একজন সার্থক শিল্পী হয়েছিলেন । পরবর্তীসময়ে তিনিও অনেক গুণী শিল্পী তৈরি করেছেন ।

 ত্রিপুরার সংগীত সমাজ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মুখ্য পরিচর্চা ও অনুশীলনকারী । সমগ্র ত্রিপুরায় আজ যে শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যের চর্চা চলছে সেটাও একদিন রাজানুকূল্যের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই পল্লবিত হয়ে উঠেছিল । সেই সংগীত-নৃত্যের মহীরুহের মূল কারিগর ছিলেন কিন্তু ত্রিপুরার রাজন্যকুল ।

রাজপ্রাসাদ ও হোলি উৎসব

ত্রিপুরায় হোলিকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টীয় ১৬০০ শতক থেকে মহারাজ দ্বিতীয় রাজধর মানিক্য থেকে শুরু করে শেষ নৃপতি বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজ অন্তঃপুরের 'হোলি' নৃত্য গীত সহকারে পরিবেশিত হওয়ার যে বাতাবরণ একদা সৃষ্টি হয়েছিল এরই নির্যাস ক্রমে ক্রমে আমজনতার মাঝে প্রসারিত হতে থাকে । পরবর্তী সময়ে এই হোলিতে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে 'হোলি কাব্য গীতি' । মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্যের হোলি বা 'হোরি' কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় উনবিংশ শতাব্দীতে । এই গ্রন্থে চারটি পদ লিপিবদ্ধ আছে । রাসলীলাকে উপলক্ষ করে কবি হোরি খেলার সুন্দর চিত্র এঁকেছেন–

                    রসে ডগমগ ধনী আধ আধ হেরি
                    আঁচল সঁঞে ফাগু লে কুঁয়ারী 
                    হাসি হাসি রসবতী মদন তরঙ্গে 
                    দেয়ল আবির রসময় অঙ্গে
                    সুচতুর নাহ হৃদয়ে ধরু প্যারী 
                    মুচকি মুচকি হাসি হেরত গৌরি

বিংশ শতাব্দীতে মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য নিজ ডায়েরিতে বিভিন্ন হোলির গান রচনা করে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন । পরবর্তী সময়ে তাঁর এই সুযোগ্য দ্বিতীয় পুত্র মহারাজ কুমার সহদেববিক্রম কিশোর পিতা কর্তৃক একদা রচিত বইটির পুনর্মুদ্রণ করেন । এরই কিছু প্রামানিক তথ্য এখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে–

রাজ অঃন্তপুরে একদা হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে রাগ প্রধান হোলি সংগীত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল । এরই নিদর্শন নিয়ে আগরতলায় রাজ অঃন্তপুরের বাইরে ছোট ছোট হোলির গানের দল গড়ে উঠতে থাকে যেমন–

 ১) মহারাজ বীর বিক্রমের নিজস্ব ফাগুয়া সংঘ ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে ।

 ২ ) মহারাজ কুমার নরেন্দ্রকিশোরের হোলির দল ।

৩ ) রাণী উজ্জলা দেবী শুধুমাত্র মহিলাদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি যথার্থ হোলির দল ।  'শ্রীগোপাল' এই নামে একটি নৃত্যনাট্য প্রতিবছর পরিবেশন করতেন ।

 ৪ )রানি সাহেবা হিমানী দেবীর হোলির দল । এর গানগুলি মুখ্য মহারাজকুমারী সুচারু দেবী কর্তৃক রচিত ।

৫ )১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে হরেন্দ্র কিশোর দেববর্মা তথা হরি কর্তার নেতৃত্বে ত্রিপুরা ফাগুয়া সম্মিলনীতে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের যুবকদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় ।
৬ ) ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ কুমার হেমন্তকিশোর দেববর্মনের 'হেমন্ত ভবন' থেকে 'বসন্ত সমাগম' নামে একটি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল । এর গানগুলি রচনা করেছিলেন মহারাজকুমারী সুচারু দেবী । সুরারোপ করেছিলেন মহারাজকুমার হেমন্ত কিশোর । তাঁর কন্যা কুমারী ঝর্না দেববর্মা মাত্র এগার বছর বয়সে নিজের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানটি গেয়েছিল । গানটি ছিল এরূপ–

                           রাগ–বাগেশ্রী
              শুনি কার প্রাণের মৃদু বাঁশরী,
               মনোবীণা তার উঠে ঝংকারী 
               সুরহিল্লোলে দুলিয়া দুলিয়া,
               তন্ময় হিয়া যায় উছলিয়া,
               তারি মাঝে ভাসে আশালতিকা 
               জড়ায়ে ফাগুয়া স্মৃতি মল্লিকা । 

এছাড়াও রানী হিমানি দেবী রচিত কিছু কিছু গান মহারাজ কুমার হেমন্তকিশোর সুরারোপিত মিশ্র রামকোষ, বসন্ত বাহার, শিবরঞ্জনী, ত্রিপুরারই সুরে গীত হত ।

 ১৯৪৩ থেকে ৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গড়ে উঠেছিল মধ্যপাড়ার প্রবীরকর্তার হোলির দল । এরই একটি গানের কলি– ফাগুন খেলত নবনাগর, রসে ধস ধস তনু, আধো আধো হেরি, চুয়া চন্দন দেয় বেড়ি বেড়ি ।

একদা শাস্ত্রীয় সংগীতের আধারে যে সমস্ত গীত মহারাজ বীরচন্দ্রের রচনায় বিশেষ করে হোলিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল, এরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর প্রপৌত্র মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর ও তাঁর অপর প্রপৌত্রী মহারাজকুমারী বিভাষপ্রভা দেবী ( মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোর মানিকের কন্যা ও মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্যের ভগিনী ) মনিপুরী নৃত্যকলার মাধ্যমে উক্ত সংগীতসমূহ পরিবেশন করে গেছেন । মহারাজ কুমারী বিভাষপ্রভা দেবীর রচনা 'গোলাপী-গোলাপ' ও 'কনকচাঁপা' নামের শাস্ত্রীয় সংগীত আশ্রিত গীতিনাট্যের পরিচালনায় ছিলেন শ্রীমতি উজ্জ্বলা দেবী ( মহারাজ বীরেন্দ্র কিশোরের অপর কন্যা ) এবং গীতিনাট্যের সংগীত রচনা ও সুর সংযোজন করেছিলেন মহারাজ বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য । ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ বাংলা ১৩৩৭ সালের ১৪ই ফাল্গুন মহারাজ বীর বিক্রমের রচিত রাগ আশ্রয়ী 'কুহেলি' ও 'পাপিয়া' হোলীগীতি মুখ্যত ব্রজবুলি ও বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছিল । যেমন–

বাংলায়–

                            আবিরে ডগমগ 
                            ভাগিনা কানাইরে 
                            ছিঃ ছিঃ  লাজে মরি 
                            নন্দ ঘোষ তোর পিতা বটে 
                             অয়ন ঘোষ তোর মামা 'রে 
                             তুমি তো ভাগিনা কানাই 
                             আমি তোর মামিরে

ব্রজবুলি–

                               কানৈয়া মোসে 
                               খেলো হোরি 
                               ভরি ভরি পিচকারি 
                               মোরি আঁচল পর মারি 
                               দেখতো সব লোকে 
                               কানৈয়া মোসে ।

 মহারাজ বীরবিক্রম কিশোর রচিত হোলি পুস্তকটি ১৩৫১ ত্রিপুরাতে ( ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ তথা ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ ) রচিত হয়েছিল ।

মহারাজ কুমার বিপিন ও বঙ্কিম দেববর্মা ভ্রাতৃযুগল তৎকালীন সময়ে মঞ্চস্থ নাটকে শাস্ত্রীয় সংগীতের আধারে সুর সংযোজন করতেন । ত্রিপুরার সঙ্গীত শিল্পীদলের কন্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতে একচ্ছত্র আধিপত্য ত্রিপুরার রাজান্যকুলেরই অবদান । মহিলা শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী গণের মধ্যে ঝর্না দেববর্মা,  আরতি কর ( চৌধুরী ) পথিকা দেববর্মা, কণিকা দেববর্মা রাজন্যযুগের শেষ শতকের সার্থক শাস্ত্রীয় কন্ঠশিল্পী । শাস্ত্রীয় যন্ত্রসঙ্গীতে লহরী দেববর্মা, ত্রৈম্বক শর্মা, উৎপল দেববর্মা, অনাথবন্ধু দেববর্মা, কালিকিংকর দেববর্মা, রাজানুকূল্যের উত্তর সাধক ও সার্থক প্রতিনিধি । ত্রিপুরার রাজবংশে যথার্থ রাজ প্রতিনিধি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে শিক্ষা প্রাপ্ত ও বাংলার লোকসংগীত, আধুনিক রাগাশ্রিত,বাংলা, হিন্দি, বিভিন্ন শৈলীর সংগীতের সুরকার ও গায়ক শ্রদ্ধেয় রাজকুমার শচীন দেববর্মন ।


সমসাময়িককালের ত্রিপুরার নৃত্য চর্চা

ভারতের শাস্ত্রীয় নৃত্যের সবকটি ধারা না হলেও কিছু কিছু নৃত্য ধারার প্রচলন পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য দেখতে পাওয়া যায় । প্রাচীনকাল থেকে এই ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় এ রাজ্যে সঙ্গীত-নৃত‍্য প্রবাহের ধারা দেখতে পাওয়া যায় । রাজন্য আমলে ত্রিপুরায় যে নৃত্যের একটি প্রবহমান ধারা ছিল তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি ।

বর্তমান পর্বে আমরা স্বাধীনতার ত্রিপুরা অর্থাৎ বিগত শতাব্দীর ৫ ও ৬ দশক থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত ত্রিপুরায় শাস্ত্রীয় নৃত্যের চর্চার একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার প্রয়াস নেব ।

আমরা লক্ষ্য করেছি যে রাজন্য আমলের সুপ্রাচীন কাল থেকেই ত্রিপুরায় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার একটা প্রবাহ গড়ে উঠেছিল এবং যে ধারাটি স্বাধীনতার কালেও অর্থাৎ পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে পরবর্তী সময়ে কমবেশি চর্চার অবকাশ ছিল । সে সময়ে নৃত্যচর্চার প্রধান গুরু ছিলেন কৃষ্ণ জিৎ সিংহ, গুরুচন্দ্রজিৎ সিংহ প্রমুখ । তাঁরা প্রধানত মনিপুরী নৃত্যের বিষয়ে কমবেশি পারঙ্গম ছিলেন । তাঁরা ওই সময়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিয়মিত নৃত্যের তালিম দিয়ে কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে সুযোগ্য করে তুলেছিলেন । যার ফলশ্রুতি হিসেবে পরবর্তীকালে এই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী ও অধ্যবসায়ের গুণে বৃহত্তর ভারতবর্ষের নৃত্য আঙ্গিনায় স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন এই প্রজন্মের নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্যরা হলেন প্রতিমা চৌধুরী, হিরা দে, ডঃ পদ্মিনী চক্রবর্তী, রেনুকা সিনহা, শিপ্রা ভট্টাচার্য প্রমুখ । উল্লিখিত নৃত্যশিল্পীদের অনেকেই পরম সম্মান ও সুনামের অধিকারী হয়ে নৃত্যের আঙিনায় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় বিরাজমান আছেন । যেমন নৃত্যশিল্পী প্রতিমা চৌধুরী আগরতলায় তালিম নিয়ে পরবর্তীকালে বোম্বের স্বনামখ্যাত নৃত্যগুরু কল্যাণ সুন্দরমের নিকট উচ্চ পর্যায়ের তালিম গ্রহণ করে ভারতের নৃত্যজগতে প্রচুর সুনামের অধিকারী হয়েছেন । তেমনি ড. পদ্মিনী চক্রবর্তী ও হীরা দে পরবর্তী সময়ে আরো উন্নততর নৃত্যের তালিম গ্রহণ করে ত্রিপুরার নৃত্য চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেন । তাঁরা ত্রিপুরার ধ্রুপদী নৃত্য চর্চার ধারাকে একবিংশ শতাব্দীতেও  দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন ।

এই দশকের অন্যান্য নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে দুজনের নাম সবিশেষ উল্লেখনীয় । এঁরা হচ্ছেন স্বর্গীয় অনন্ত বিজয় দেববর্মা ও শ্রীমতি পূরবী চন্দ । তাঁরা উভয়ই শান্তিনিকেতন থেকে নৃত্য শিক্ষা করে ত্রিপুরায় নৃত্য প্রশিক্ষণের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন । 

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ত্রিপুরায় আগমন ঘটেছে গুরু বিহারীরঞ্জন সিংহের । তিনি সুদুর জয়পুর থেকে কত্থক নৃত্য বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে ত্রিপুরায় নৃত্য প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন । তখন থেকেই ত্রিপুরার নৃত্যাঙ্গনের এই বিশেষ দিকটির উন্মোচন ঘটে । পরবর্তীকালেও তাঁরই সুযোগ্য শিক্ষকের দ্বারা আবির্ভাব ঘটে সুদক্ষ কত্থক নৃত্যশিল্পী শীলা সেনগুপ্তা ও শিবানী চক্রবর্তীর । এ দুজন নৃত্যশিল্পী কত্থক নৃত্যে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়ে দর্শকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন । বলা যায়, গুরু বিহারীরঞ্জন সিংহের সুদক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই দুজন খ্যাতনামা শিল্পীর নৃত্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পরম কৃতিত্ব প্রদর্শনের ফলে ত্রিপুরায় মনিপুরী নৃত্যের পাশাপাশি কত্থক নৃত্যের প্রতি শিক্ষার্থীদের পরম আগ্রহ সঞ্চারিত হয় । ফলত, আগরতলা সরকারি মিউজিক কলেজে ১৯৬৫ সন থেকে শুরু হয় কত্থক নৃত্যের ক্লাস । এই বিষয়ে প্রথম দিকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিখা চক্রবর্তী, নন্দা মুখার্জি, স্বপ্না চৌধুরী প্রমুখরা । তারপর ৭০ এর দশক নাগাদ এলেন উমাশঙ্কর চক্রবর্তী । শিপ্রা সেনগুপ্তা, বন্দনা দাস, জবা ঘোষ, অমিতাভ ভট্টাচার্য, অনিন্দিতা দত্ত, শিখা সাহা, হৈমন্তিকা দেববর্মন, রুপা সেনগুপ্তা প্রমুখ এক ঝাঁক নৃত্য শিক্ষার্থী । সেই সময় থেকে কত্থক নৃত্য সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে । সৃষ্টি হল সর্বোচ্চ নৃত্যের জোয়ার । এই জোয়ারে আবির্ভাব ঘটল সুমনা পাল ( অকাল প্রয়াতা ) নমিতা, নীলাঞ্জনা, ইন্দিরা এবং আরো অনেকের । ওই একই সময়ে  মনিপুর থেকে ত্রিপুরায় এলেন সুদক্ষ নৃত্যশিল্পী অঙ্গনতোম্বি সিং । তিনিও সরকারি মিউজিক কলেজে নৃত্য প্রশিক্ষকের পদে যোগদান করলেন । তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন রুনা পাল, সোমা দত্ত, বঙ্কিম সিংহ, প্রমুখরা । তাছাড়া রমেশ দত্ত ও কৃতিত্বের সঙ্গে অনেক ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেছেন ।

৭০ দশকের শেষের দিকে ত্রিপুরায় ভরতনাট্যমের প্রথাগত শিক্ষা শুরু হয় সরকারি মিউজিক কলেজে শ্রীমতি পদ্মিনী চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে । এর আগে থেকে শ্রীমতি হীরা দে ভরতনাট্যম শেখাতেন আগরতলা রবীন্দ্র পরিষদে । কিন্তু সেখানে কোন সরকারি ডিগ্রী দেওয়া হতো না । এই সময় থেকেই আগরতলা শহরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ভরতনাট্যম চর্চার আগ্রহ সঞ্চারিত হয় । উল্লিখিত দুজন প্রশিক্ষিকার নিকট তালিম পাওয়া অনেক ছাত্রছাত্রী আজ এই নৃত্যের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন অথবা অনেকেই চলে গেছেন স্মৃতির অন্তরালে নানা কারণে । তাদের কিছু নাম এখানে তুলে ধরছি । যেমন শুক্লা বিশ্বাস, উমা চক্রবর্তী, গোপাল বিশ্বাস, অজন্তা বর্ধন রায়, মৌসুমী চ্যাটার্জী, শাশ্বতী দেব, নিবেদিতা তরফদার, সুহৃতা ঘোষ, এমিলি দেব, অ্যাঞ্জেলিনা, একতা, দীপশিখা, দেবলীনা, বিন্দিয়া, ঋতুপর্ণা, সায়নী, ছন্দশ্রী, পায়েল, ডিনা ঘোষ, পামেলা, অম্বালিকা, শর্মিষ্ঠা, জয়িতা সেনগুপ্ত ইত্যাদি । এরা সকলে ভরতনাট্যম অথবা রবীন্দ্র নৃত্য চর্চায় তালিম নিয়েছে ।

এর পাশাপাশি বিহারীবাবুর ছাত্র উমাশঙ্কর চক্রবর্তীর কিছু ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে উদ্যম সহকারে নৃত্য চর্চা করে যাচ্ছে বা একটা সময় নৃত্য চর্চা করেছে । তার মধ্যে পার্বতী ভট্টাচার্য, অম্লান চক্রবর্তী, শ্রী রূপা দাস, সর্বাণী নন্দী, কমলিনি চক্রবর্তী, দেবব্রত দেববর্মা, বিক্রম সিনহা, গৌতম গুপ্ত, রিতা সাহা, শাশ্বতী কর্মকার, চিন্ময় দাস, চন্দ্রতপা সাহা, দেবজ্যোতি লস্কর, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, মৌমিতা ভট্টাচার্য, শীলা সাহা, রেশমি দাস, মণিদীপা চক্রবর্তী, মানসী ঘোষ, সুস্মিতা বণিক, দীপিকা নন্দী, পূজায়িতা দেববর্মা, সুব্রত রায়, সঞ্জীব সিনহা, কুশল দেব প্রমুখ ।

আশির দশক থেকে ত্রিপুরায় শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চার পরিসর বেড়ে যায় । আগরতলার বাইরেও সে সময়ে মফস্বলের বিভিন্ন শহর যেমন, কৈলাশহর, ধর্মনগর, উদয়পুর, সোনামুড়া, বিলোনিয়া, খোয়াই, সাবরুম বিশালগড় এমনকি প্রত্যন্ত কাঞ্চনপুরে, মোহনপুর, গোমতী জেলার অমরপুরেও নৃত্যশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠেছে ।   আগরতলার বাইরে শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার কথা বলতে গেলে প্রথমেই ধর্মনগরের কথা উল্লেখ করতে হয় । সেখানে বেশ কয়েকটি নৃত্যশিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে । তার মধ্যে 'কলামন্ডল' নামটি অবশ্যই আলোচনা করতে হয় । জবা ঘোষ, সজল, চিরশ্রী আরো কয়েকজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী ভরতনাট্যম কথক ও মনিপুরী নৃত্য চর্চা করেছে বেশ সাফল্যের সঙ্গে । এছাড়া, এখানে কিছু মনিপুরী নৃত্যশিল্পী আছেন যাঁরা তাঁদের পরম্পরা ও মনিপুরী নৃত্য চর্চা করে যাচ্ছেন বেশ সাফল্যের সঙ্গে । তার মধ্যে গুরু বিপিন সিংহের সুযোগ্য ছাত্রী লক্ষ্মী সিনহার নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে । বেশ কিছু নামি মনিপুরী নৃত্য শিক্ষক আছেন । শিল্পীও আছেন শ্রীমতি ঋতুপর্ণা সিংহ, শ্রীমতি আলপনা সিংহ, শ্রীমতি ভারতী সিংহ, শ্রীমতি অনিন্দিতা সিংহ । তাছাড়া কত্থক নৃত্যে অর্পিতা দেব গুপ্তা, অন্যান্য নাচে বাবুল সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে নৃত্য চর্চা বজায় রেখেছেন । কমলপুরে, ধলাই জেলায় মনিপুরীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভালো নৃত্যশিল্পী আছেন ।খোয়াই মহকুমায় মনিপুরী নৃত্যচর্চা চলে আসছে ।‌পাশাপাশি কত্থক নৃত্য প্রসার ঘটছে । মেলাঘর ও সোনামুড়াতেও আজকাল বেশ নৃত্য চর্চা হচ্ছে । বিশালগড়ে ও মোহনপুর ব্লকের বামুটিয়ায় মনিপুরীরা বাস করে তাই এই অঞ্চলে তাদের প্রথাগত নৃত্যের চর্চা দীর্ঘদিন যাবত চলে আসছে । এই অঞ্চলের ব্রজেন্দ্র সিংহ পুষ্প সিং শিক্ষক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন ।

এ রাজ্যের গোমতী জেলায় উদয়পুর একটি প্রধান নৃত্যচর্চার কেন্দ্র । ত্রিপুরার প্রথম কুচিপুড়ি নৃত্যশিল্পী ববি চক্রবর্তী এই উদয়পুরের সন্তান । তাছাড়া উমাশঙ্কর চক্রবর্তীর অনেক ছাত্র-ছাত্রী উদয়পুর এবং অমরপুরে রয়েছে । তাই এই অঞ্চলে কত্থক নৃত্যের প্রভাব খুব বেশি । উদয়পুরের নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মনিকা নন্দী,   চলেছে এবং তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে ।

No comments:

Post a Comment