Saturday, March 11, 2023

রাজন্য ত্রিপুরায় বসন্তোৎসব ও হোলির গান

রাজন‍্য ত্রিপুরায় বসন্তোৎসব ও হোলির গান

                                                    অশোকানন্দ রায়বর্ধন


বসন্ত একটি ঋতু । বছরের ছয় ঋতুর শেষ ঋতু । শীতঋতুতে প্রকৃতিকে যে রুক্ষতা গ্রাস করে, শুষ্ক করে, বৃক্ষের পত্রাদি ঝরে শীর্ণতার রূপ ধরে,  বসন্ত এসে সেখানে প্রকৃতিতে রং লাগিয়ে দেয় । প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে যেন সবকিছু সুন্দর হয়ে ওঠে । গাছে গাছে সবুজ কচি পাতায় ছেয়ে যায় । এই সবুজের আড়ালে বসে কোথাও মধুর সুরে কোকিল ডেকে ওঠে । বনে বনে রঙের উচ্ছ্বাস লাগে ।  কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে ফুলে লাল হয়ে ওঠে । কোথাও বনের মধ্যে পলাশ ফুটে ওঠে । ফুলে ফুলে সুন্দর আর চিরসবুজ হয়ে ওঠা দুনিয়ায় রঙের পরশ লাগে । কৃষি মরশুমেরও সূচনা করে বসন্ত । অশুভের বিরুদ্ধে শুভশক্তির বিজয় ও চিরন্তন প্রেমের ঘোষণা করে বসন্ত । বসন্তে জীবন যেন বর্ণময় হয়ে ওঠে । নীল, লাল, হলুদ, গোলাপি আবির আর গুলালে মানুষ মেতে ওঠে বসন্ত উৎসবে, রঙের উৎসবে । প্রিয়জনকে রঙে রঙে রাঙিয়ে বর্ণময় করে তোলার উল্লাস জাগে । যেন সমস্ত রং উজাড় করে দিতে চায় মন আপনজনকে । বসন্তের এই দিনে আসে ফাগের উৎসব । যার আরেক নাম 'হোলি' । বসন্তউৎসব প্রেমের উৎসব । তারুণ্যের উৎসব । এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের চিরন্তন ঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও মিথ ।

পৌরাণিক কাহিনিতে আছে শিব ও পার্বতীর বিবাহ উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রাধা ও কৃষ্ণের উদ্যোগে এই উৎসব পালিত হয় । রাধা ও কৃষ্ণ ভারত উপমহাদেশের চিরন্তন প্রেমের প্রতীক ।‌ বৈষ্ণবদের বিশ্বাস অনুযায়ী প্রচলিত যে, ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোগিনীগণের সঙ্গে রং খেলায় মেতে ছিলেন । এ বিষয়ে একটি মজার কাহিনি প্রচলিত আছে  ।  কৃষ্ণের গায়ের রং ছিল কালো ।‌ তাই সে মা যশোদার কাছে প্রায়ই তার গায়ের রং নিয়ে অনুযোগ করত । বিশেষত রাধার গায়ের রং উজ্জ্বল ছিল বলে তাকে হিংসা করত কৃষ্ণ । একবার যশোদা রহস্যছলে  কৃষ্ণকে বললেন যে,  সে ইচ্ছে করলে রাধাকে নিজের পছন্দমতো রঙে রাঙিয়ে তার গায়ের রং পাল্টে দিতে পারে ।‌ চঞ্চল কৃষ্ণ তখন দুষ্টুমি করে রাধা ও তার গোপিনী বন্ধুদের রং লাগিয়ে দিলেন । রাধার প্রতি কৃষ্ণের ভালোবাসার এই চপলতাই হয়ে উঠল স্বর্গীয় প্রেমের এক চিরকালীন লোককথা ।‌ হোলি এভাবেই হয়ে উঠল চিরন্তন ভালবাসা ও বন্ধুত্বের প্রতীক । রাধাকৃষ্ণের প্রেমের উপর ভিত্তি করেই হোলি হয়ে উঠেছে রং, আনন্দ ও ভালবাসার প্রতীক । বলা হয়ে থাকে এই ঘটনা থেকেই দোল উৎসবের সৃষ্টি । দোলের দিন শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহকে আবির গুলালে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে শোভাযাত্রা বের হয় । ভক্তমন্ডলী পরস্পরকে রং মাখিয়ে প্রমোদখেলায় মেতে ওঠেন । বসন্তের এই রঙের উৎসবকে ঘিরে আরো লৌকিক উৎসব প্রচলিত আছে । তার মধ্যে এক বিশেষ উৎসব হল, 'হোলিকা দহন' বা 'ন্যাড়া পোড়া' । দোলের পূর্ব দিন ছন, বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু দিয়ে ঘর নির্মাণ করে তা জ্বালিয়ে দিয়ে বিশেষ বহ্নুৎসব পালন করা হয় । 

'হোলি' ভারতের একটি জাতীয় উৎসব । দেশের বিভিন্ন প্রদেশে প্রাচীনকাল থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে । কোথাও 'হোলি', কোথাও 'ফাগ' নামে । তেমনি ত্রিপুরা রাজ্যেও বহু প্রাচীনকাল থেকে এই উৎসব 'হোরি' নামে পালিত হয়ে আসছে । ত্রিপুরার রাজ পরিবারকে কেন্দ্র করে হোলি উৎসব বা বসন্ত উৎসব উদযাপনের একটা ঐতিহ্য অতীত থেকেই গড়ে উঠেছে । রাজমালার প্রথম লহরে ত্রিলোচন খন্ডে 'দুর্গোৎসব দোলোৎসব জলোৎসব চৈত্রে' লেখা হলেও হোলি উদযাপন সম্পর্কে তেমন বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না । তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কাল থেকে দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে হোলি উদযাপিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় । মূলত, মণিপুর রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই ত্রিপুরার রাজপরিবারও বৈষ্ণব ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে । ত্রিপুরার মহারাজা দ্বিতীয় রাজধর মানিক্য ( ১৭৮৫–১৭৯৭ খ্রি. ) মনিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা হরিশেশ্বরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন । ভাগ্যচন্দ্র রাজধর মানিক্যের হাতে কন্যা সম্প্রদানের পাশাপাশি ত্রিপুরার রাজবাড়িতে তাঁর ইষ্টদেবতা রাধামাধবের বিগ্রহও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । রাজকন্যার সঙ্গে নৃত্যের কুশীলব, গায়ক ও বাদ্যযন্ত্রীরা সেই সময় আগরতলায় এসে বসবাস শুরু করেন এবং রাধামাধবের নিত্যপূজা শুরু করেন । ফলে, বৈষ্ণবীয় বিনয় ও  মর্যাদার সঙ্গে সেই সময় থেকে এই রাজ্যে 'হোরি' উৎসব পালন করার ঐতিহ্য সৃষ্টি হয় । সেদিনের রাজারা সমস্ত রকমের রাজোচিত গাম্ভীর্য, মর্যাদা ও অহংকারকে দূরে সরিয়ে প্রজাদের আন্তরিকতার সঙ্গে এই উৎসবে আহ্বান করতেন । প্রজা সাধারণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই নির্মল আনন্দে শামিল হতেন । প্রজারা সেদিন রাজ সন্দর্শনে  নিয়ে যেতেন ভক্তিমিশ্রিত আবির । মহারাজ ও তার প্রতিদানে প্রচারের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন 'প্রসাদী রাঙ্গা ধূলিকণা' । সে সময় রাজবাড়ির হোলি  উৎসবে বাইরের অতিথিদের ও নিমন্ত্রণ জানানো হত‌ । রামগঙ্গা শর্মা লিখিত 'কৃষ্ণমালা' কাব্য থেকে জানা যায় যে, মহারাজা কৃষ্ণ মানিক্যের সময়ে চট্টগ্রামের ইংরেজ গভর্নর হ্যারি ভারলেস্ট ও তার কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীকে রাজবাড়ির হোরি উৎসবএ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । কৃষ্ণমালায় আছে–

                                         আতর গোলাপ গন্ধে সভা আমোদিত ।।
                                         সুগন্ধি আবির চূর্ণ আমি ভারে ভারে ।
                                         কুঞ্জ কুঞ্জ করি রাখে সবার মাঝারে ।।
                                         পাত্রগণ সহিতে বসিল মহারাজ । 
                                         হারিবিলাস সাহেব প্রভৃতি ইংরাজ ।।
                                         সবে মিলি বসি তথা খেলাইলো হুলি ।
                                         ফল্গুচূর্ণ পরস্পরে অঙ্গে মারে মেলি ।। 
                                         সুললিত নানা বাদ্য চতুর্দিকে বাজে ।
                                         নর্তকী সকল নাচে মনোহর সাজে ।।
                                                                                      ( কৃষ্ণমালা, রামগঙ্গা শর্মা )

প্রকৃতপক্ষে সেই সময় থেকেই ত্রিপুরা রাজপরিবারে প্রত্যেকবছর বসন্তপূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন হোলি উৎসব উদযাপনের রীতি প্রচলিত হয়েছে ।

ত্রিপুরা রাজ্যের হোলি উৎসব মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের ( ১৮৬২খ্রি.–১৮৯৬খ্রি. ) আমলে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে । মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য নানাবিধ গুণে গুণান্বিত ছিলেন রবীন্দ্র-স্নেহধন্য ভারতের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মন বীরচন্দ্র মানিক্যের গুণাবলির কথা উল্লেখ করেছেন– 'নবযুগের প্রবর্তক গুণী মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য । তিনি বাংলা ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন, সুকবি, বৈষ্ণব সাহিত্যের সুপন্ডিত, সঙ্গীতজ্ঞ,  শাস্ত্রজ্ঞ, সংগীত রচয়িতা, সুরস্রষ্টা, উর্দুভাষায় মাতৃভাষা ন্যায় আলাপে সক্ষম, কূটনীতি পরায়ণ, বাকপটু ও সর্বোপরি তিনি একজন সুনিপুণ চিত্রকর ও ফটোগ্রাফার । ( ত্রিপুরার শিল্পের ইতিবৃত্ত–ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মন ) । মহারাজা স্বয়ং ছিলেন বৈষ্ণব কবি । তিনি তাই হোলি উৎসবে মেতে উঠতেন । হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে তিনি গান রচনা করতেন । পরবর্তীকালে তাঁর গানগুলি 'হোরি' নামক কাব্যগ্রন্থ আকারে প্রকাশ পায় । বীরচন্দ্র মানিক্যের হোরি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কোনো তারিখ পাওয়া যায় না । তবে ধারণা করা হয় গ্রন্থটি ১৮৯১–৯২ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় রচিত হয় । বইটিতে ২৪ টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । হোরি কাব্যটি ভক্তিরসের নিদর্শন বলে ধরে নেওয়া যায় । তাঁর কবিতায় বৈষ্ণবীয়  পদাবলী সাহিত্যের লক্ষণ বিদ্যমান । বীরচন্দ্র তাঁর কাব্যে বৃন্দাবনের বসন্তপ্রকৃতির যে মনোরম বর্ণনা দিয়েছেন তাতে তাঁর অসাধারণ কবিত্বশক্তির নিদর্শন পাওয়া যায়—

                                             আজু অপরূপ বৃন্দা বিপিকি মাঝে 
                                             বিহরই ঋতুরাজ মনোহরো সাজে,
                                             নবীন পল্লবে কিবা সুশোভিত ডাল 
                                             কত সারী সুক পিক গাওয়ে রসাল ।
                                             নানা জাতি ফুলদলে শোভিত কানন অন্তে, 
                                             মৃদু মৃদু বহতহি মারুত  বসন্তে ।

মহারাজা বীরচন্দ্রের কবিতায় রাধাকৃষ্ণের হরি খেলার চিত্র ফুটে ওঠে–

এক. 
                                            রসে ডগ মগ ধনী আধো আধো হেরি
                                            আঁচলে ফাগু লেই কুঁয়রী
                                            হাসি হাসি রসবতি মদন তরঙ্গে,
                                            দেয়ল আবির রসময় অঙ্গে 
                                            সুচতুর নাহ হৃদয়ে ধরু প্যারী 
                                            মুচকি মুচকি হাসি হেরত গৌরী ।

দুই.
                                             ফাগু খেলত রাধাকানু
                                             সব সখী রঙ্গিনি গায়ে সুতান
                                             চুয়া চন্দন পরিমল কুমকুম 
                                             লাল গোলাপ উড়াওত অফুরান,
                                             মদন বিমোহন হেরি সে মাতল
                                             গায়ে যুবতী মেলি হোরি ঝুমুরি,
                                              বীণা রবাব মুরজ মধুর বায়ত 
                                              নাচত রায় শ্যাম ঘেরি 
                                              নুপুর ঝর্ণা নানা মৃদঙ্গ তাতা থৈ তাথৈ তাথৈ 
                                              রুনু ঝুনু বোলে ঘুঙ্গুরী,
                                              ব্রজ বনিতাকূল রি ঝি রি ঝি নাচত 
                                              মারত ঘন পিচকারি । 
                                              বীরচন্দ্র দাস মন‌ ভরি গাওত 
                                              রায় কানু খেলত হোরি ।

বীরচন্দ্রের 'হোরি' কাব্যে কৃষ্ণসহ হোলি খেলায় রত রাধিকার মধ্যে যে ভাবরসের সঞ্চার ঘটেছে তাতে রাধিকাকে ধীরা রমণীর মত আবেগে আনতভাবা দেখা যায় । তার কবিতায় রাধা এবং কৃষ্ণের রূপ বর্ণনায়ও উৎকর্ষতার ছাপ রয়েছে ।

মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের মৃত্যুর পর তার পুত্র রাধাকিশোর মানিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯খ্রি. )ত্রিপুরার রাজা হন । রাধাকিশোর মানিক্য নিজে ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক । ১৩০৬ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ 'কাহিনী' কাব্যটি রচনা করেন এবং তা মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের নামে উৎসর্গ করেন । রবীন্দ্রনাথ ঋতুরাজ বসন্তকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে বসন্ত পূর্ণিমার দিন শান্তিনিকেতনে শুরু করেন ঋতুরঙ্গ উৎসব । ১৯৩২ সাল থেকে এই উৎসব 'বসন্ত উৎসব' নামে পরিচিত হয় । রবীন্দ্র-সান্নিধ্যধন্য রাধাকিশোর বসন্ত উৎসবের প্রতি আগ্রহী ছিলেন । তাঁর নিজের একটি সৌখিন নাটকের দলও ছিল । তিনি তাঁর পিতার ন্যায় কিছু বৈষ্ণবপদ রচনা করেছিলেন । এগুলো তাঁর রাজত্বকালের সীমার মধ্যে রচিত । তাঁর মৃত্যুর পর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র দেববর্মা দোলপূর্ণিমা উপলক্ষে 'ফাল্গুনী' নামে একটি গীতি সংকলন প্রকাশ করেন । সেখানে মহারাজা রাধাকিশোরের কিছু পদ অন্তর্ভুক্ত করা হয় । পরবর্তী সময়ে 'বসন্তরাস' নামে আরো একটি গীতি সংকলন প্রকাশিত হয় । সেখানেও রাধাকিশোরের রচিত কিছু পদ স্থান পেয়েছিল । রাধাকিশোর তাঁর কিছু কিছু পদের ভনিতায় নিজেকে বৃন্দাবনচন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন । রাধাকিশোরের রচিত  পদাবলিসমূহ রাস উৎসব ও দোলযাত্রা উপলক্ষে সেই সময়ের কীর্তনীয়াগণ মৃদঙ্গ ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান করতেন । তাঁর পদাবলীর একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হলো–

                                                  দেখো ফাগু খেলত নাগর রায় 
                                                  ফাগু লেই সখিগণ সঙ্গে 
                                                  হাসি হাসি সুন্দরও মনমথ রঙ্গে 
                                                  খেলত হোলি শ্যাম নাগর সঙ্গে 
                                                  চুয়া চন্দন ভরি পিসকারী মারত 
                                                  পুন পুন দেই চন্দন 
                                                  দুহাত ভরি আবির কুমকুম 
                                                  মারত নেহারি বদন 
                                                  সব সখি সঙ্গে আবির খেলত 
                                                  আজু শ্যামরাই ভৃঙ্গে 
                                                  লাল লাল গাহি খেলত ফাগু 
                                                  ঋতুপতি মনমথ রঙ্গে 
                                                  শ্রীশ্যাম সুন্দর রাধারানী সঙ্গে 
                                                  আনন্দে মগন ভেল
                                                  দীন রাধা কিশোর দুহু গুণগানে 
                                                  সমর্পিত প্রাণ হৈল । 

মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে নভেম্বর ত্রিপুরার রাজা ( ১৯০৯–১৯২৩খ্রি. ) হন । তিনি ও তাঁর পিতা পিতামহের ন্যায় গুণের অধিকারী ছিলেন । তিনি ছিলেন একজন উঁচুদরের চিত্রশিল্পী । মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য কিছু বৈষ্ণব পদ ও 'দোললীলা' নামে একটি নাটিকা রচনা করেছিলেন । নাটিকাটির শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় যে তিনিও তাঁর পূর্বপুরুষদের ন্যায় বসন্ত উৎসবে আগ্রহী ছিলেন ।

ত্রিপুরায় হোলি উৎসবের যে পরম্পরা তৈরি হয়েছিল তা মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্যের (১৯২৩–১৯৪৭খ্রি. ) শাসনামলেও পরিলক্ষিত হয় । হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে বীরবিক্রমও কিছু রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক সংগীত রচনা করেছেন । মহারাজ বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য নিজের ডায়েরিতে বিভিন্ন হোলির গান রচনা করে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন । তাঁর রচিত গানগুলি ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে 'হোলি' নামক কাব্যগ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় । পরবর্তী সময়ে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র  সহদেববিক্রম কিশোর দেববর্মন তাঁর রচিত গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণ করেন । উৎসব সম্পর্কে মহারাজা বীরবিক্রম স্বয়ং বলেছেন, '' হোলি উৎসবটি যেন নর-নারীর প্রচেষ্টা, প্রেমকে পার্থিব জগৎ হইতে বহু উচ্চে লইয়া যাওয়া— প্রেম পূর্ণ প্রাণের আবেগকে যেন ভগবানে নিবেদন করা— ভগবান যিনি স্বয়ং প্রেমের প্রতিরূপ ।" বীরবিক্রম ব্রজবুলি ও বাংলা দুই ভাষাতে পদ রচনা করেন । 

রাজন্য আমলের সংগীতনিপুন ঠাকুর অনিলকৃষ্ণ দেববর্মা কয়েকটি হোলির গান রচনা করেছেন । সেকালের রাজঅন্তঃপুরের মহিলারাও হোলির গান রচনা করতেন । রাজমহিষীদের মধ্যে রাধাকিশোর মানিক্যের মহিষী মহারানি তুলসীবতী দেবী, বীরেন্দ্রকিশোরের মহিষী মহারানি প্রভাবতী দেবী ও তাঁদের কন্যা সুচারুবালা দেবী ও কিছু হোলির গান রচনা করেছিলেন । ত্রিপুরার রাজ পরিবার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আগরতলার ঠাকুরবংশীয়দের মধ্যেও কেউ কেউ হোলির গান রচনা করেছিলেন । ত্রৈমাসিক 'রবি' পত্রিকার চৈত্র ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে এমন কিছু গান প্রকাশিত হয়েছিল । এমনকি ককবরক ভাষায় ও সেকালে হোলির গান রচিত হয় । এই 'রবি' পত্রিকাটিতে লেখা হয়েছিল, "হোলির দিন  তাহারা ( রাজা ও রাজপরিবারের সংশ্লিষ্ট সকলে, ঠাকুরলোক ও আগরতলার অধিবাসীবৃন্দ ) লালে লাল হইয়া নাচিয়া গাহিয়া বাঁশি বাজাইয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া উঠে ।" সে সময় আগরতলা শহরে প্রায় পঞ্চাশটি হোলিগানের দল ছিল । তার মধ্যে কিছু মনিপুরীদের দলও ছিল । ঢোলক, মৃদঙ্গ, করতাল, বাঁশি ও হারমোনিয়াম সহযোগে হোলির গান গাওয়া হত । রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদেরও হোলি গানের দল ছিল । এবং তাঁরা নাচে গানে মেতে উঠতেন । 

হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে ত্রিপুরার রাজপরিবারে একসময় হোলিসঙ্গীতের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল । একদা রাজ্যে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের আধারে রচিত গীতসমূহ হোলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল । সেই ধারা আজও রাজ্যে বিদ্যমান ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. ত্রিপুরায় শতাব্দীর প্রবন্ধ চর্চা– রমাপ্রসাদ দত্ত, ড. ব্রজগোপাল রায়
২.  শতাব্দীর ত্রিপুরা– নির্মল দাশ, রমাপ্রসাদ দত্ত
৩.  ঐতিহ্য ও ইতিহাসের পটে ত্রিপুরা (১ম খন্ড )– রমাপ্রসাদ দত্ত
৪.  প্রবন্ধ সংগ্রহ– করবী দেববর্মণ
৫. ত্রিপুরা রাজমালা– পুরঞ্জন প্রসাদ চক্রবর্তী
৬. ত্রিপুরার রাজআমলের বাংলা সাহিত‍্য– ড. রঞ্জিত চন্দ্র ভট্টাচার্য
৭. ত্রিপুরার রাজঅন্দরে সাহিত‍্য চর্চা– ড. মুকুল কুমার ঘোষ

No comments:

Post a Comment