Monday, March 20, 2023

অন্তরে দহন অনন্ত

অন্তরে দহন অনন্ত 


ধুপ পুড়ে গেলে পোড়া ছাই পললহীন মৃত্তিকার মতো । যতক্ষণ আগুন ছিল ততক্ষণ ছিল দহন । দাহ্য শরীর জ্বলে জ্বলেই শেষ হয়ে যায় । অতলস্পর্শী তাপ সারা শরীরে মেখে ক্রমাগত পুড়ে যায় অবয়ব । দহনের ফসল তার গন্ধ । যে গন্ধ কোমলতায় ভিজিয়ে দেয় বাতাসের দিঘল শরীর । যে বাতাস বয়ে যায় চৈত্রসন্ধ্যার রুক্ষ মাঠ পেরিয়ে রাতপল্লীর নির্ধারিত আলপথে । দহনক্লিষ্ট ধূপের নিঃশ্বাস শব্দহীন নিঃশেষ হয় । নিঃশ্বাসে থাকে জীবনের ঘ্রাণ । শতশত নৈঃশব্দ্যের বুদবুদ নীরব অভিমানে অনিশ্চিত ঠিকানায় পাড়ি দেয় । যোজন যোজন দূরের অলিতে-গলিতে চলে খোঁজ । সমূহসন্ধান । দগ্ধধূপের ঘ্রাণের সুগন্ধময় অতিক্রমণ অনুভূত হয় নিস্তব্ধ বাসরঘরে, বৈভবের বহুতলে, একাকী চিলেকোঠায় । নগরীর সব বিষাক্ত নির্যাস স্নাত হয় ধূপগন্ধের মৃদু সৌরভে । দূর নাচমহলের নর্তকীর বন্দিশের অস্ফুট নূপুর কান্নার মতো । জ্বলে গেলেও যে শরীর কাঁপতে জানে না ।

কি দহন ছিল রাইকিশোরীর বুকে সে কেবল জানে ব্রজভূমির গোপযুবতিরা । দাবানল দৃষ্টিগোচর হয় । দাগ রেখে যায় তার দগ্ধক্ষেত্রের । লেলিহান আগুন রেখে যায় যে কালিকাপুর তা দু চার বর্ষণেও মুছে যায় না । প্রকৃতির বহ্নিজ্বালা চরাচরকেও ঝলসে দেয় অদৃশ্য বেদনায় । রাধা শুধু পোড়ে আর পোড়ে । জ্বলে যায় অন্তরে বাহিরে । আর সে জ্বলন জগত জানে না । সংসার জানে না । নিজের রক্তের ভিতরে বাসা বেঁধে থাকে কষ্টের কর্কট । বুকের ভেতর বনজদস্যুর যে তোলপাড় চলে, যেভাবে ভেঙে যায় তার প্রণয়ইমারত তা কারো দৃষ্টিগোচর হয় না । একা একা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দিনলিপি ভেসে যায় যমুনার কালো স্রোতে, কালস্রোতে । অন্তরের গনগনে দাবানলে যে পুড়ে যায় সে কি চায় নশ্বর পরিণতি ? শেষ দহন ? রাধা ও তাই শেষবার্তা জানায় তমালকে ঘিরে । তমালের প্রসারিত শাখা যেন তাকে আলিঙ্গন করে নেয় । জড়িয়ে ধরে তার সহস্র বাহু দিয়ে । যে দৈহিক আশ্লেষ তার চঞ্চল নুপুরকে স্থবির করেছে, মানবিক প্রণয়কে হাহাকারে রূপান্তরিত করেছে, সেই হতাশার কাতরতা থেকে বেরিয়ে আসার নবীনমুদ্রা যেন তমালের প্রাচীন বল্কলের অভ্যন্তরে নিহিত আছে । অস্থির দহনযাতনার শেষে রাই খোঁজে অপার্থিব প্রেমাঙ্কুর । সুবিন্যাস্ত তমালের গায়ে ঝরে পড়া শ্রাবণকীর্তন যেন হয় রাধার অনাহত কৃষ্ণধূন । দহনকোকিলের তান  মায়ামেদুর করে তোলে ব্রজের আকাশ । শেষ বসন্তে ।

নিজের চেতনার অন্তর্মহলে পুড়ে পুড়েই নিমাই উদ্বাহু হয়ে যান কীর্তনের ভেতর । কবিতার মতো হাসেন, কবিতার মতো গেয়ে ওঠেন, আনন্দে মাতেন । তাঁর দহন তাঁকে তৃষ্ণার্ত করে । সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিশাল জলধিপ্লাবন দিতে পারে না তাঁর তৃষ্ণার জল । তিনিও জীবনভর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুঁজে ফেরেন শান্তির জল । দহনের নিবৃত্তি । তিনিও খুঁজে ফেরেন শীতলপদাবলী । যার সুর তাঁকে উদ্বেল করে মানবিকতায় । কারণ মানবের লাঞ্ছনায় তাঁর অন্তরে নীরব দাবানল । চিরঅচলায়তন ভাঙার জন্য তিনি খুঁজে নেন নীলাচল ।

দহনক্লান্তা লোকরমণী কাঁদেন ব্রজভুবনে । আর দগ্ধচিত্ত চিরায়ত পুরুষ ঝাঁপ দেন নীলাচলের নীলদরিয়ায় । দুজনেই অন্তর্দাহের মিথ । লৌকিক চরিত্র । দুজনকে ঘিরেই আমাদের পদাবলীপ্রবণ গান । বিচ্ছেদসঙ্গীত । আর এই বিচ্ছেদপদ উঠে যার খাগের কলমে তিনি পদকর্তা । তিনি কবি । তাঁর অন্তরেও সীমাহীন দাহ্যপ্রবাহ । শোকসিন্ধু । সিন্ধু উথলানো তাঁর কবিতা । এই দুই দহনপ্রতিমার উত্তাপ তাঁর অন্তরেও হয় সঞ্চারিত । সেই সঞ্চরণ থেকে কবির সৃজন । কবি অন্তরের অগ্ন্যুৎৎপাত ছড়িয়ে পড়ে কবিতার ভাষায় । অন্তর্গত চৈতন্য দহনে সৃজনের উন্মুখর বারুদশলাকা । তাই যে কবির অন্তরে দহন অনন্ত ।

No comments:

Post a Comment