Tuesday, May 2, 2023

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ : কিছু তথ্য

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পন  :  কিছু তথ্য


অশোকানন্দ রায়বর্ধন


রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের দীর্ঘকাল ব্যাপী সম্পর্কের ধারাবাহিকতা তৈরি হয় । মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য থেকে শুরু করে তার প্রপৌত্র মহারাজা বীরবিক্রম— ত্রিপুরার এই চার রাজার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের এই সম্পর্কের সূত্র ধরে ত্রিপুরার সাহিত্যে আধুনিকীকরণের গতির সৃষ্টি হয় । ত্রিপুরার সাহিত্য সৃষ্টি সেই রাজমালার যুগ থেকে চিহ্নিত করা হয় । একসময় পয়ার এবং ত্রিপদী ছন্দের ধরাবাঁধা কাব্যে আটকে ছিল সে সাহিত্য । মহারাজা বীরবিক্রম সেই ধারাকে আধুনিক রূপ দিতে চাইলেন । শুধু নতুন কিছু ছন্দ প্রয়োগে নয় । বিষয়বস্তু নিয়েও এগিয়ে গেলেন । ইতিহাস আর কিংবদন্তির পরিমন্ডল ছাড়িয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ ঘটালেন তাঁর কবিতায় । বীরচন্দ্র রচিত কাব্য 'ঝুলন',  'হোরি',  'অকাল কুসুম',  'উচ্ছ্বাস',  'সোহাগ',  'প্রেম মরীচিকা' ইত্যাদি । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সম্পর্কের যখন সূত্রপাত ঘটে তখন মহারাজা বীরচন্দ্র প্রায় প্রৌঢ়বয়স্ক । আর রবীন্দ্রনাথ যখন জীবনের দিনান্তে অবস্থিত তখন ত্রিপুরার সিংহাসনে ছিলেন যুবক রাজা বীরবিক্রম কিশোর  মাণিক্য ।


রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে বীরচন্দ্রের কন্যা অনঙ্গমোহিনী দেবী যে কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন তা ছিল অনেক বেশি আধুনিক । অনঙ্গমোহিনী দেবীর কাব্য 'শোকগাথা',  'প্রীতি',  ও 'কণিকা' বিশ শতকের প্রথম দশকে প্রকাশিত হয় । কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রপ্রভাব লক্ষ করা গেলেও তাঁর কাব্য বিগত শতকের গোড়ায় আধুনিকতা এনে দিয়েছিল । ত্রিপুরার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মানুষজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রবীন্দ্রনাথ সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন । ত্রিপুরার পটভূমিকায় তিনি লিখেছেন 'রাজর্ষি',  'বিসর্জন' এবং 'মুকুট' ।


তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থের জন্য প্রথম অভিনন্দন পেয়েছিলেন ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের কাছ থেকে । 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যটি ১২৮৭ বঙ্গাব্দে ধারাবাহিকভাবে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৮ বঙ্গাব্দে বৈশাখ মাসে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় তা । প্রকাশিত হবার পরের বছর অর্থাৎ ১২৮৯ বঙ্গাব্দে মহারাজা বীরচন্দ্রের প্রধানা মহিষী ভানুমতী দেবীর জীবনাবসান ঘটে ।‌ শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে রাজা তখন বিরহের কবিতা লিখে লিখে শোকভার লাঘব করার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক এই সময়েই মহারাজার হাতে আসে তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' । এই কাব্যগ্রন্থটি হাতে পেয়ে তিনি যেন বিরাট আশ্রয় পেলেন ।  তাঁর বিরহী অন্তরে নাড়া দেয় এই কাব্যগ্রন্থ । তিনি গভীর উৎসাহ নিয়ে পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' । তিনি মনে মনে ভাবলেন, এ বোধহয় কোন বয়স্ক কবির লেখা । তাঁর পারিষদবর্গ তাঁকে জানালেন যে, রবীন্দ্রনাথ একজন তরুণ কবি এবং আরো জানালেন যে, এই কবির পরিবারের সঙ্গে অর্থাৎ কবির পিতামহ প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মহারাজার পিতৃদেব কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের নিবিড় সম্পর্ক ছিল তাঁদের একটা পারিবারিক মামলাকে কেন্দ্র করে ।


 'ভগ্নহৃদয়' পাঠের পর পরই মহারাজ বীরচন্দ্র তাঁর নিজস্ব সচিব শ্রদ্ধেয় রাধারমন ঘোষ মহাশয়কে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পাঠালেন কবির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার জন্য । তরুণকবি রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি 'ভগ্নহৃদয়'-র সুর বীরচন্দ্রের বিরহী প্রাণে বিশেষ সাড়া জাগিয়েছিল ।  মুগ্ধ বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে ভূষিত করেন 'কবি' উপাধিতে । রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই প্রথম স্বীকৃতি লাভ । সেই প্রথম কোন খেতাবপ্রাপ্তি । জীবনে প্রথম সম্মান লাভের সঙ্গে সঙ্গে 'ত্রিপুরা' শব্দটি সেদিন থেকে রবীন্দ্রনাথের  অন্তরে গেঁথে যায় । তাঁর নোবেল প্রাপ্তির তিন দশক আগেই বিশ্ব যেদিন রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারেনি সেদিন শুধু ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেছিলেন । চিনেছিলেন তার কাব্যপ্রতিভাকে । সেই সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায় ৬০ বছরের সম্পর্ক ছিল ত্রিপুরার ।


সৃজনশীল জীবনের একেবারে উষালগ্নে রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়'কে কেন্দ্র করে তাঁকে যে সম্মান এনে দিয়েছিল তা তিনি জীবনের অন্তিম পর্বেও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন । ১৯৪১ সালের ২৫শে বৈশাখ ত্রিপুরার রাজদরবারে  সেদিন কবির জন্মদিনের উৎসব পালিত হয়েছিল । এই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মহারাজা বীরবিক্রম ঘোষণা দিলেন শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিশ্বকবিকে 'ভারত ভাস্কর' সম্মান প্রদান করা হবে । পাঁচ দিন পর ৩০ বৈশাখ শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে আয়োজিত হয় সেই বিশেষ অনুষ্ঠান । ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীরবিক্রম কবিকে জীবনের শেষ সম্মান 'ভারত ভাস্কর' প্রদান করলেন । একটি বিশেষ হুইলচেয়ারে বসিয়ে  কবিকে সভাস্থলে আনা হল । ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম সেই অনুষ্ঠানে কবির হাতে তুলে দিলেন  ত্রিপুরার মানুষের পক্ষ থেকে  সম্মান আর অর্ঘ্য ।


'ভগ্নহৃদয়' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে কবির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সূচনা হলেও তা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাঁর 'রাজর্ষি' উপন্যাসের ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের তাগিদে প্রেরিত এক চিঠির মাধ্যমে । একটি 'স্বপ্নলব্ধ' গল্পের ঐতিহাসিক উপাদান চেয়ে মহারাজা বীরচন্দ্রের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ১২৯২ বঙ্গাব্দে প্রথম 'বালক' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় রাজর্ষি । আষাঢ় থেকে মাঘ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় এর ২৬ টি অধ্যায় । রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে গেছেন 'এ আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প' । রাজর্ষি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জীবন স্মৃতিতে লিখেছেন—


'...  ... দুই এক  সংখ্যা বালক বাহির হইবার পর একবার দু-একদিনের জন্য দেওঘরে রাজনারায়ণ বাবুকে দেখিতে যাই । কলিকাতায় ফিরিবার সময় রাত্রের গাড়িতে ভিড় ছিল, ভালো করিয়া ঘুম হইতেছিল না— ঠিক চোখের উপরে আলো জ্বলিতেছিল । মনে করিলাম, ঘুম ঘুম যখন হইবেই না তখন এই সুযোগে বালকের জন্য একটা গল্প ভাবিয়া রাখি । গল্প ভাবিবার ব্যর্থ চেষ্টার টানে গল্প আসিল না, ঘুম আসিয়া পড়িল । স্বপ্ন দেখিলাম, কোন্ এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, 'বাবা, একি ! এ যে রক্ত ! বালিকার এই কাতরতায় তাহার বাপ অন্তরে ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোন মতে তাহার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে—জাগিয়া উঠিয়াই মনে হইল এটি আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প । এমন স্বপ্নে পাওয়া গল্প এবং অন্য লেখা আমার কাছে আরও আছে । এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের পুরাবৃত্ত মিশাইয়া রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে 'বালকে' বাহির করিতে লাগিলাম ।'


এই গল্পের ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের কাছে গোবিন্দ মাণিক্যের রাজত্বকালীন ইতিহাস, উদয়পুরের ফটোগ্রাফ ইত্যাদি চেয়েছিলেন । রাজর্ষির আগে ত্রিপুরার ইতিহাসনির্ভর গল্প 'মুকুট' লিখেছিলেন তিনি । মুকুটে রয়েছে রাজা অমর মালিকের রাজত্বকাল, তার পুত্রদের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বন্দ, আরাকানরাজের সঙ্গে যুদ্ধ ইত্যাদির কথা । তাতে ধারণা করা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে থেকেই ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে ত্রিপুরার বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহ করতেন ।


মহারাজা বীরচন্দ্রের আমলেই কলকাতায় যুবরাজ রাধাকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল । তবে সে সময়ে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি । সিংহাসনে আরোহণের ( ১৯০০ খ্রি. ) পর প্রথমদিকে তিনি নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন । তার মধ্যেও  রাধাকিশোরের সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় । রাধাকিশোর মাত্র বারো বছর রাজত্ব করেছিলেন । এই সময়ের মধ্যেই কবির সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে । কবি ও রাজাকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিষয়ে নানা পরামর্শ দিতেন । 


রাধাকিশোর মাণি এবংক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আগরতলায় আসেন । সেসম্বন্ধে 'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা', রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে একটি লেখায় আমরা পাই,


 ''কবি সম্বর্ধনার আয়োজন হইল পুরাতন কুঞ্জবনের সু-উচ্চ টীলায় শ্রীপঞ্চমী উপলক্ষে বসন্তোৎসবে ( ১৩০৬ ) । ত্রিপুরার আদিবাসীদের টঙ্ ঘরের নমুনায় সম্বর্ধনা মঞ্চ তৈরি হইল । মুলি বাঁশের তৈরি মঞ্চের গড়ন ও ফুল পাতায় সজ্জা পরিপাটি শিল্প শোভার নিদর্শন । মঞ্চের উপর হইতে নজর পড়ে চারিদিকে উচ্চ নিচ পাহাড়গুলি থরে থরে ঢেউ খেলিয়া দূর দিগন্তে মিলাইয়া গিয়াছে— আকাশের নীল চন্দ্রাতপ দিগন্ত রেখাকে চুম্বন করিয়া ঋতু উৎসবকে আরো কমনীয় করিয়া তুলিয়াছে । এই প্রাকৃতিক পরিবেষ্টনকে আরো সম্বর্ধিত করিয়াছে দলে দলে নৃত্যগীতরত মণিপুরী শিল্পীবৃন্দ । নগ্ন গাত্র, পরিধানে বাসন্তী রং এর কাপড়, লম্বমান বাসন্তী চাদর গলায়— মাথায় বাসন্তী রঙের পাগড়ী, খোল, মন্দিরা করতালের সমতলে পদবিক্ষেপ ও দেহভঙ্গিমা— দীর্ঘলয়ে কীর্তনের সুর এক মোহময় আবেশ রচনা করিতেছিল । দর্শক যাহারা, তাহারাও স্ত্রীপুরুষ সেই বাসন্তী রং-এর পরিচ্ছদে ভূষিত । এই পরিবেশের মধ্যে কবি ও রাজা মঞ্চোপরি ফরাস বিছানায় আসীন । কালোপযোগী নৃত্যগীত ও পুষ্পসজ্জার উপহার— রাজা প্রজার সমব্যবহার— কবির কবির মনকে এক অভূতপূর্ব আনন্দ ও বিস্ময়ে অভিভূত করিয়া দিল ।" ( ত্রিপুরায় রবীন্দ্রস্মৃতি, সত্যরঞ্জন বসু /  রবীন্দ্রনাত ও ত্রিপুরা, তৃতীয় মুদ্রণ-মে ২০১১, পৃ. ১৫ )  


এছাড়া প্রাগুক্ত গ্রন্থে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রজীবনী- ১ম খন্ড থেকে উদ্ধৃতি  দিয়ে প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক দ্বিজেন্দ্রচন্দ্র দত্ত মহোদয় লেখেন—


"বসন্ত সমাগমে ( ১৩০৬ ) সম্ভবত শ্রীপঞ্চমীর সময়, মহারাজের নিমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় সর্বপ্রথম আগমন করেন এবং রাজ অতিথিরূপে কর্নেল মহিম ঠাকুরের জন্য নির্মিত গৃহে অবস্থান করেন । উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের নির্মাণকার্য তখনও চলিতেছে । কবির শুভাগমন উপলক্ষে সহরের উপকণ্ঠস্থ পুরান কুঞ্জবনের শৈলশিখরে  কবির সম্মানে বসন্ত উৎসবের ও মনিপুরী নৃত্যগীতাদির মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান আয়োজিত হইল ।" ( তথ্য ক্রমপঞ্জি–শ্রী দ্বিজেন্দ্র দত্ত / রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ-১২৫-১২৬ ) ।


১৩০৬ বঙ্গাব্দের বসন্ত পঞ্চমীতে রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় আগমনের তারিখ সম্বন্ধে পরবর্তী সময়ে মতান্তর দেখা দেয় । সম্ভবত, প্রাগুক্ত দুই লেখক রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের তখনকার মতো প্রামাণ্য গ্রন্থটি অনুসরণ করার কারণেই  এরূপ তথ্য উল্লেখিত হয়েছে । ত্রিপুরা আঞ্চলিক রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী সমিতি, আগরতলা কর্তৃক রবীন্দ্র শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ 'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' প্রথম প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১৩৬৮ বাংলা । পুনর্মুদ্রণ হয় ফাল্গুন ১৩৯৩ বাংলা ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ ইং এবং তৃতীয় মুদ্রণ হয় বৈশাখ ১৪১৮ বাংলা, মে ২০১১ ইং । এই গ্রন্থের তৃতীয় মুদ্রণের মুখবন্ধের সংযোজনীতে ( ২ ক-খ ) তথ্যসহ উল্লেখ করা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় এসেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র ( ২৭ মার্চ ১৮৯৯ ইংরেজি ) । সেখানে উল্লেখ আছে–


                           মহারাজা রাধাকিশোরের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আগরতলা পরিভ্রমণ


২ ( ক ) 'রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা' গ্রন্থে ( দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ পৃষ্ঠা ১৫, ১২৪, ১২৫ ) উল্লেখ রয়েছে যে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের শ্রীপঞ্চমী উপলক্ষে বসন্তোৎসবে কবি প্রথমবার রাধাকিশোরের আমন্ত্রণে আগরতলা এসেছিলেন । পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে যে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ এবং শ্রী পঞ্চমী তিথি দুটোর একটাও ঠিক নয় ।


১৩০৬ বঙ্গাব্দের শ্রীপঞ্চমী তিথি ছিল ২২শে মাঘ ( রবিবার ৪ ফেব্রুয়ারি ) । প্রশান্ত পাল লিখেছেন,

 '২২শে মাঘ সরস্বতী পূজার দিন রবীন্দ্রনাথ সংগীত সমাজে যান সারস্বত সম্মিলনে যোগদান করতে... ২৩শে মাঘ ( সোমবার  ৫ ফেব্রুয়ারি ) রবীন্দ্রনাথ আবার প্রিয়নাথ সেনের বাড়ি যান । এই দিনে দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথের ছোটবোন সুনয়নী দেবীর কন্যা বীণাপাণীর বিবাহ হয়' । ( রবীন্দ্রজীবনী, চতুর্থ খন্ড, চতুর্থ মুদ্রণ, ১৪১৫ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা ২৬০ ) । অতএব রবীন্দ্রনাথের সেদিন আগরতলা আগমনের তথ্যটি সঠিক নয় । 


দ্বিতীয় প্রমাণ হিসেবে প্রশান্ত পাল উল্লেখ করেছেন যে–

 "১৩০৫ সালের ৮ ফাল্গুন রবীন্দ্রনাথ শৈলেশচন্দ্র মজুমদারকে লিখেছিলেন, 'চৈত্রমাসের আরম্ভে ত্রিপুরার মহারাজার নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে আমাকে একবার ত্রিপুরায় যেতে হবে ।' সেই হিসেবে ৭ চৈত্র সরকারি কেশবহিতে 'ত্রিপুরার মহারাজাকে দিবার জন্য' উপহার সামগ্রী ক্রয়ের হিসাব রয়েছে । প্রশান্ত পাল সমস্তরকম হিসেব-নিকেশ করে দেখিয়েছেন যে, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের শ্রীপঞ্চমী নয়, ১৩০৫ বঙ্গাব্দের দোলপূর্ণিমার দিন অর্থাৎ ১৪ চৈত্র সোমবার ২৭ মার্চ ১৮৯৯ তারিখে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পন করেন ।" ( রবি জীবনী চতুর্থ খন্ড চতুর্থ মুদ্রণ ১৪১৫ বঙ্গাব্দ পৃষ্ঠা ২০২২ ২২৩ ) ।


২ ( খ ) এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা গ্রন্থের মুদ্রণের ১৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, ১৩০৬ সনের গোড়ার দিকে ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথকে একটু স্বস্তিদান করার জন্য রাধাকিশোর বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে ত্রিপুরায় আমন্ত্রণ করেছিলেন । ঘটনাটি ঠিক নয় । কেননা বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৩ ভাদ্র ( ১৯শে আগস্ট ১৮৯৯ ), আর রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র ( ২৭ মার্চ ১৮৯৯ ইং ) ।


সেবার তিনি রাজঅতিথি হিসেবে কর্নেল মহিম ঠাকুরের বাড়িতে অবস্থান করেন যেহেতু তখনো রাজপ্রাসাদ সম্পূর্ণ নির্মিত হয়নি । কবির প্রথমবার কর্নেল বাড়িতে অবস্থান সম্পর্কে একটি বিশেষ তথ্য পাই বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শঙ্খ শুভ্র দেববর্মনের মাতা সবিতা দেববর্মনের 'পাতার ভেলা ভাসাই নীরে' গ্রন্থটির একটি প্রবন্ধে । এখানে তিনি তাঁর ঠাকুরমা কর্নেলবাড়ির মেয়ে শশীমঞ্জরী দেবীর কাছ থেকে শৈশবে শোনা বিবরণ তুলে ধরেছেন–


 ''মহারাজ কর্নেলবাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন । গুরুদেবের আগমন উপলক্ষে ঠাকুরমাসহ সব বোনেরা, বউয়েরা মিলে খুব সুন্দর পুষ্পশিল্পের আয়োজন করেছিলেন । মধুগন্ধে ভরা বিভিন্ন রংবাহারি ফুল দিয়ে ফুলের বিছানা তৈরি করেছিলেন । মাথার বালিশে ফুল দিয়ে সাজিয়েছিলেন । অপূর্ব কারুকার্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটি ফুল দিয়ে লিখিত হয়েছিল । রংবেরঙের ফুল দিয়ে ফুলের পাখা তৈরি করে রেখেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে বিছানাতে ফুলের আলপনা, বালিশে ফুল দিয়ে নিজের নাম লেখা দেখে শিহরিত, আনন্দিত, অবাক হয়ে বিছানার পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন । শেষে বিছানার পাশে যে চেয়ার ছিল সেই চেয়ারটিতে বসে পড়লেন । সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীও ছিলেন । 


ফুলের পাখা দেখে নাড়াচাড়া করে কে কে এই পাখা তৈরি করেছিলেন । তাদের ডেকে আলাপ পরিচয়ও করেছিলেন । ঠাকুরমার সঙ্গে তখনই পরিচয় হয়েছিল । পুষ্পশিল্পীদের অপূর্ব শিল্প কৌশলের প্রতি মুগ্ধ হয়ে তিনি বসেননি সেই বিছানাতে, এমনকি শয়নও করেননি । এই পুষ্প বিছানার কাছে আরেকটি শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । এরপর থেকে নাকি তিনি ত্রিপুরার পুষ্পশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ।"

 

কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকন্ঠে  কুঞ্জবনের শৈলশিখরে  কবির সম্মানে বসন্তোৎসবের ও মণিপুরী রাসনৃত‍্যের আয়োজন যে করা হয়েছিল তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে  ।


এই ঘটনাটির আরো বিস্তৃত বিবরণ পাই আর একটি লেখায় । সেখানে দেখি–


"........... দাদামহাশয় একবার গুরুদেবের ত্রিপুরা আগমন সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন তা আমার এখনো মনে আছে । মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যের বিশেষ আমন্ত্রণে ত্রিপুরার বসন্ত উৎসব উপলক্ষে ১৩০৬ সনে তিনি আগরতলায় এসেছিলেন । তখন ভূমিকম্পের ভাঙ্গা ত্রিপুরা মহারাজার প্যালেশের যাবতীয় মালমশলার দান পেয়ে সবেমাত্র দাদা মহাশয়ের নতুন বাড়ি প্রস্তুত হয়েছিল । মহারাজ সে বাড়িতেই তখন গুরুদেবের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন । দাদামহাশয়ের মুখে জ্ঞাত হয়েছিলুম– গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের কর্নেল বাড়িতে আগমন উপলক্ষে আমার এক দিদিমা খুব মনোরম পুষ্পশিল্পের আয়োজন করেছিলেন । তিনি গুরুদেবের সমস্ত শয্যার উপর ও বালিশে অপর্যাপ্ত রঙবেরঙের পুষ্পাভরণের নক্সা পরিকল্পনায় সাজিয়ে দিয়েছিলেন । বিশেষ করে মাথার বালিশটি অপরূপ রঙিন ফুলের শিল্পরসের শোভা বর্দ্ধন করিতেছিল । বালিশের উপর এই আলপনাসংসৃষ্ট শিল্পকীর্তিতে বিশেষ করে বালিশের মধ্যস্থলে 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' নামাঙ্কিত করে অপরূপ পুষ্পশিল্পের সৃজন করেছিলেন । সেদিন গুরুদেব দাদা মহাশয়ের সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমেই সোজা নতুন বাড়ির পশ্চিম কামরায় প্রবেশ করতে যাবেন, ফাল্গুনের অযাচিত মিশ্রিত ফুলের গন্ধে বিভোর হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন এবং দাদামহাশয়কে বলেছিলেন, 'মহিম ঠাকুর,  কী চমৎকার গন্ধ !' তারপর ঘরে প্রবেশ করতেই চারিদিকে আবহাওয়ার পরিবেশে সুবাসিত পুষ্পগন্ধে মুগ্ধ হয়ে বিছানার পাশে যে চেয়ারটি ছিল সেখানে বসে পড়লেন । তাঁর আতিথ্যরসপূর্ণ কক্ষে শয্যার অপরূপ পুষ্পশিল্পের নিদর্শন নিরীক্ষণ করে তিনি খুব আশ্চর্যান্বিত হয়ে গিয়েছিলেন । বিশেষত তাঁর বালিশের রূপসজ্জা দেখে আরো মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং শিল্পী দিদিমার সহিত পরিচয় করবার জন্য দাদামহাশয়ের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন । তখন দিদিমারা সকলেই উপস্থিত ছিলেন । দাদামহাশয় প্রত্যেককে সাক্ষাৎ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন । গুরুদেব পুষ্পশিল্পী দিদিমাকে দেখে তার পুষ্পশিল্পের কারুকৌশলের খুব সুখ্যাতি বর্ণনা করেছিলেন এবং আন্তরিক সাধুবাদ দিয়েছিলেন । তিনি পুষ্পশিল্পীর অপূর্ব শিল্পকৌশলের প্রতি মুগ্ধ হয়ে সে বিছানায় বসেন নাই, এমনকি শয়নও করেন নাই । কেবল বিছানার পাশে আরাম কেদারায় বসে বসে ফুলের গন্ধ ও পুষ্প শিল্পের মাধুর্য হৃদয়ে গ্রহণ করে কৃতার্থ হয়েছিলেন । সেদিন দাদামহাশয়কে আর একটি শয্যার ব্যবস্থা তার পাশেই করে দিতে হয়েছিল । ( রবীতীর্থ স্মৃতি– শ্রী শৈলেশচন্দ্র দেববর্মা, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা পৃষ্ঠা ১৯৭–১৯৮ ) ।


১৩০৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার আগরতলায় আসেন ।এসময় শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ‍্যালয় স্থাপনের ব‍্যাপারে মহারাজের সঙ্গে আলোচনা হয় । এই বিদ‍্যালয়ের জন‍্য মহারাজ বাৎসরিক একহাজার টাকা মঞ্জুর করেন । এছাড়া মহারাজ ত্রিপুরার অনেক ছাত্রকে ছাত্রবৃত্তি দিয়ে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়েছিলেন শিক্ষাগ্রহণের জন‍্য । বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারেও কবি মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করেন । মহারাজ জগদীশচন্দ্রের জন‍্য দশ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন এবং কিছুদিন পরে দশ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন । সেবার তিনি জুরি বৈঠকখানায় বসবাস করেন । উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ সংলগ্ন পাশাপাশি দুটো 'কাঁচা বাংলো' নির্মিত হয়েছিল । বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরের প্রায় ৩০০ ফুট উত্তরে এ জোড়াবাংলো অবস্থিত ছিল সেদিন ।


১৩১২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ তৃতীয়বার আগরতলায় আসেন । সেবারও জোড়াবাংলোয় অবস্থান করেছিলেন । সেটা ছিল আষাঢ় মাস । ১৭ আষাঢ় স্থানীয় উমাকান্ত একাডেমি হলে মহারাজ রাধাকিশোরের উপস্থিতিতে ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় সভাপতি হিসেবে সুচিন্তিত ও সারগর্ভ 'দেশীয় রাজ্য' প্রবন্ধটি পাঠ করেন কবি ।


১৩১২ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে কবি পুনরায় আগরতলায় আসেন । এবার তিনি ত্রিপুরার নবনিযুক্ত রাজমন্ত্রী রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের কর্মভার গ্রহণ উপলক্ষে জগদীন্দ্রনাথ প্রভৃতি সহ চতুর্থবারের মতো এলেন এখানে । 


১৩১২ বঙ্গাব্দেই চৈত্র মাসে পঞ্চমবার পুনরায় রবীন্দ্রনাথ আগরতলায় আসেন । এবারের আসার কারণ হিসেবে জানা যায় চৈত্র মাসে ইস্টার অবকাশের সময় বরিশালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের ( যা এরপর পুলিশি জুলুমে  দক্ষযজ্ঞে পর্যবসিত হয় ) অন্তর্ভুক্ত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবার জন্য । 


১৯১৯ খ্রি. অর্থাৎ ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরদরবারের আমন্ত্রণে কার্তিক মাসে ত্রিপুরার পরম সুহৃদ ও মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে কোলকাতা যাবার পথে ষষ্ঠ বারের মতো ত্রিপুরায় আগমন করেন । কবির মনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তাঁর থাকার জন্য এই কুঞ্জবনের এক প্রান্তে  নয়াভিরাম ঘন সবুজ বনানীর কোলে চারিদিকে অজস্র ফুলের মাঝখানে একটি কাঠের ছোট্ট বাংলো তৈরি করা হয় । প্রত্যহ নিত্য নতুন বিহঙ্গের কলকাকলি মুখরিত এই স্থান কবির বড়ই প্রিয় ছিল । এই বাংলোর নাম শিল্পী মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর নামকরণ করেন 'মালঞ্চাবাস' ( মালঞ্চ + আবাস ) । আবাসটি ছিল মোটা উলুছনের ছাউনিযুক্ত চৌচালা ঘর । বাঁশ বেতের অপূর্ব কারু শিল্পের নকশার কাজ করা বেড়া দেওয়া । মেঝেতে কাঠের পাটাতনের উপর সুদৃশ্য কাশ্মীরি কার্পেট বিছানো । রাতে জ্বলত চিনা ঝাড়লন্ঠন । দুদিকে গোলাপ ও কাঁঠালি চাঁপার ঝাড় । কত দূর থেকে ভেসে আসা আদিবাসীদের সুরেলা জাদু কলিজার গানের সুরের সঙ্গে বাজত বাঁশির সুমিষ্ট আওয়াজ যা কবিকে করে রাখত আপ্লুত ।


১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ই ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মার আমন্ত্রণে কবি সপ্তম ও শেষবার আগরতলায় আসেন । অল্পবয়স্ক মহারাজ বীরবিক্রম মাণিক‍্যের সঙ্গে মহারাজকুমার বীরেন্দ্রকিশোরের এই আমন্ত্রণ তৎকালীন আগরতলার সাংস্কৃতিক জগতের সুধীমন্ডলীর পরম শ্লাঘার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেবার তিনি কুঞ্জবনপ্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন । এই সম্বন্ধে তিনি পরবর্তী সময়ে মন্তব্য করেছিলেন— 


.......''পৃথিবীতে প্রকৃতির লীলা ক্ষেত্র অনেক দেখিয়াছি কিন্তু ত্রিপুরার কুঞ্জবনের শৈল শ্বেত ভবন আমার স্মৃতি হইতে মলিন হইতে পারিতেছে না ।' 


এইসময় প্রতিদিন মণিপুরী নৃত‍্য প্রদর্শিত হত । তাছাড়া মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বসতবাটিতে এক অনুষ্ঠানে রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহের পরিচালনায় রাজ অন্তঃপুরের কুমারীগণ মণিপুরী নৃত‍্য, বসন্ত উৎসব ও রাসনৃত‍্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায় । স্থানীয় কিশোর সাহিত্য সমাজ তাঁকে ১২ ফাল্গুন তারিখে উমাকান্ত একাডেমী হলে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে ।


রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় পদার্পনের শুরুর দিন থেকে গণনা করে হিসেব করলে আজ তা একশো পঁচিশ বছরের সূচনা করল । এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে রাজ্যে ইতোমধ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে । আশা করা যাচ্ছে এই প্রয়াস গোটা বছরব্যাপীই জারি রেখেই রাজ্যে রবীন্দ্রপ্রণামের ধারাবাহিকতায় নবসংযোজন ঘটবে । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার নিবিড় সম্পর্কের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনটিও ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব পাবে ।


সহায়ক গ্রন্থ :


১.  রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা–রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, ত্রিপুরা আঞ্চলিক রবীন্দ্রশতবার্ষিকী সমিতি, আগরতলা, ত্রিপুরা সরকারী মুদ্রণালয় ।

২. আধুনিক ত্রিপুরা, প্রসঙ্গ বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য– ড. দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ গোস্বামী / অক্ষর পাবলিকেশানস্, আগরতলা

৩. অন্য রবীন্দ্রনাথ–ড. দেবব্রত দেবরায়, স্রোত প্রকাশনা, ত্রিপুরা

৪. পাতার ভেলা ভাসাই নীরে– স্রোত প্রকাশনী, ত্রিপুরা

No comments:

Post a Comment