Monday, May 15, 2023

ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথ ও মণিপুরি নৃত্যকলা

ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথ ও মণিপুরি নৃত্যকলা


একটা জনগোষ্ঠীর উন্নতির ক্ষেত্রে অপর কোন গোষ্ঠীর আচার-ব্যবহার, ভাষা সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পের আদান-প্রদানের মাধ্যমে পুষ্ট করে তোলে । ফলে এর মধ্যে একটি সমৃদ্ধ একাত্মবোধ গড়ে ওঠে এবং সেখানে সংহতির বাতাবরণ তৈরি হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে এরকম ভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির আগমন আদান-প্রদান এবং মেলবন্ধন ঘটেছে । ত্রিপুরা রাজ্যেও সেইরূপ সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে । ফলে ত্রিপুরারাজ্য হয়ে উঠেছে একটি মিশ্র সংস্কৃতির রাজ্য । ত্রিপুরার মিশ্র সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করতে গেলে বলতেই হয় যে, রত্নফা যখন মাণিক্য উপাধি নিয়ে ত্রিপুরায় ফিরে এলেন তখন তাঁর সঙ্গে নিয়ে এলেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের । যাদের সহযোগে সেদিন ত্রিপুরায় গড়ে উঠেছিল এক মিশ্রসংস্কৃতির বাতাবরণ । সেকারণে পণ্ডিতদের দ্বারা আমদানি হয় সংস্কৃত সাহিত্য ও উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির । সঙ্গে সঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে আমাদের ত্রিপুরায় সে সময় সীমানা ছিল ব্রহ্মদেশের প্রান্ত সীমা থেকে  ঢাকার কিছু অংশ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি নিয়ে । তারই ফলশ্রুতি হিসেবে ত্রিপুরাতে হিন্দু, বৌদ্ধ, শৈব ও শাক্ত সংস্কৃতির নিদর্শন পাওয়া যায় ।  এককথায় ত্রিপুরার সংস্কৃতিতেও 'দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে' পরিবেশ যথেষ্টই রয়েছে ।

ত্রিপুরার রাজারা সংস্কৃতিবান, বিদ্যোৎসাহী, উদার মনোভাবাপন্ন এবং গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সতত সচেষ্ট হিসেবে সর্বজনবিদিত । নৃত্য ও গীতের সুধাসাগরে মহারাজারা শুধু নিজেরাই নিমজ্জিত ছিলেন না, রাজঅন্দরের পুরনারীদেরও সংগীত ও অন্যান্য চারুকলার চর্চায় প্রচন্ড উৎসাহ প্রদান করতেন । ত্রিপুরার  রাজাদের ইতিহাস কালিপ্রসন্ন সেন সম্পাদিত 'শ্রীরাজমালা'য় উল্লেখ রয়েছে–

 'ত্রিহুত দেশ হইতে নৃত্যগীত আনি ।
 রাজ্যতে শিখায় গীত নিত্য নৃপমণি ।।
 ত্রিপুর সকলে সেই গীত ক্রমে গায় ।
 ছাগ অন্তে তার যন্ত্রে ত্রিপুরে বাজায় ।।

অর্থাৎ মহারাজা ধন্যমাণিক্য মিথিলা বা ত্রিহুত দেশ থেকে শিল্পী এনে রাজ্যে নৃত্যগীতের প্রচলন করেছিলেন ।

ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহত্তর অংশ হলো মনিপুরি জনগণ । ২০১১ সালের ভারতের জনগণনা অনুযায়ী ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যা ৩৬,৭৩,৯১৭ জন । আর মনিপুরি জনসংখ্যা প্রায় ২৪,০০০ । বর্তমানে রাজ্যে মনিপুরি জনসংখ্যার হার ০.৭ শতাংশ । রাজ্যের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে মনিপুরিগণ রাজ্যের অন্যান্য বাসিন্দাদের ন্যায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ত্রিপুরাকে সমৃদ্ধির পথে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন । ত্রিপরাজ্যের ধর্মনগর, কৈলাশহর, কমলপুর, খোয়াই ও সদর মহকুমাতে মনিপুরীগণ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন ।

 মনিপুরিরা মূলত মনিপুরের অধিবাসী । সাধারণত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং রোগ মহামারীর আক্রমণ কোন অঞ্চলের অধিবাসীদের অন্য স্থানে বা অন্য রাজ্যে অভিবাসনে বাধ্য করে । ত্রিপুরারাজ্যের মনিপুরিদের প্রথম অভিবাসন উপরোক্ত কোন একটি কারণের ফলে হয়েছে । রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য মনিপুরিগণ দেশত্যাগ করে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৮২৪ সালে । ১৭৬২ সালে কৃষ্ণমাণিক্যের আমলে চট্টগ্রামের রেসিডেন্ট মি. ভেরেলিস্টের পত্র থেকে জানা যায় যে, মণিপুররাজ বিখ্যাত গরীবনওয়াজের দ্বিতীয় পুত্র জগতসাই সিংহাসন থেকে  বিতাড়িত হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের মাধ্যমে ভেরেলিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেন পুনরায় ইংরেজদের সাহায্যে সিংহাসন দখল করার জন্য । কিন্তু মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্রের ( ১৭৭৩–১৭৯৮ খ্রি. ) তৎপরতায় তিনি সফল হননি । কিন্তু জগৎসাই সম্ভবত কসবা অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন কেননা পরবর্তীকালে ভাগ্যচন্দ্রের আগরতলা আগমনকালে কসবাতে জগৎশাই ভাগ্যচন্দ্রকে অভ্যর্থনা করেছিলেন বলে জানা যায় । তারপরে অবশ্য জগতসাইয়ের আর কোন সংবাদ জানা যায় না এবং তাঁর বংশধর বা পরিবার-পরিজন এর ত্রিপুরায় পাওয়া যায় না । 

সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্যে বিবাহ অন্যতম । ত্রিপুরার অনেক রাজা মণিপুরের রাজকন্যা বিবাহ করেছেন দ্বিতীয় রাজধর মাণিক্য ( ১৭৮৫–১৮০৪ )  মনিপুরাধিপতি ভাগ্যচন্দ্রের কন্যা হরিশেশ্বরীকে বিবাহ করেন । কৈলাস চন্দ্র সিংহ লিখেছেন,

 ''মণিপুরের রাজবংশের সহিত ত্রিপুরার রাজবংশের ইহাই প্রথম সম্বন্ধ ।" 
এই উক্তি পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না । কেননা আমরা দেখি যে, ত্রিপুর বংশধর তইদাক্ষিণের পুত্র দাক্ষিণ মেখলি রাজকন্যা বিবাহ করেন । অবশ্য এই বিবাহ বর্তমান ত্রিপুরার রাজনৈতিক সীমার মধ্যে ঘটেনি । বরঞ্চ বলা চলে ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের সঙ্গে মণিপুর রাজবংশের প্রথম সম্বন্ধ হয় রাজধরমাণিক্যের সঙ্গে । আবার কেহ কেহ মনে করেন কৃষ্ণমাণিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী মণিপুরের রাজদুহিতা । কৈলাস চন্দ্র জাহ্নবীদেবীর অপর নাম 'রানী তম্পা' বলে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু কমলজিৎ সিংহ উল্লেখ করেছেন যে, জাহ্নবী দেবীর অপর নাম 'সিজা তম্ফা' ।এই নামীয় কোন মহিলা মনিপুরি ভিন্ন অপর কেউ হতে পারে না । কৈলাসচন্দ্রের রাজমালা তে সিজাতমফার উল্লেখ নেই । এখানে উল্লেখযোগ্য যে, পুরাতন রাজমালা 'শ্রীরাজমালা'র মুল পাঠে এবং 'দেশীয় রাজা'তে কৃষ্ণমাণিক্যের পত্নীর নাম জাহ্নবী দেবী লেখা আছে ।  আখাউড়া স্টেশনের নিকটে রাধানগর গ্রামে অবস্থিত রাধামাধব মন্দিরের শিলালিপি অনুযায়ী কৃষ্ণমাণিক্যের পত্নী জাহ্নবীদেবী । মুদ্রার সাক্ষ্যেও আমরা তার নাম জাহ্নবী দেবী পাই । কর্নেল দেববর্মা মহাশয় তাকে অসূর্যম্পশ্যা একজন ত্রিপুরী রমণী বলে তার অনেক গুণের উপর আলোকপাত করেছেন । অন্য প্রমাণাভাবে কমলজিৎ সিংহ এ প্রসঙ্গের যবনিকা টেনেছেন । কৃষ্ণ মাণিক্য ( ১৭৪৭–১৭৮৩ খ্রি. ) শমসের গাজীর উপদ্রবে সিংহাসন দখল করতে না পেরে অনেকদিন কাছাড় ও মনিপুরের রাজসভায় সাহায্য লাভের আশায় রাজ্যত্যাগ করেছিলেন ।

আবার একটি সূত্র থেকে জানা যায়, "আনুমানিক ১৮২১ সাল থেকে ১৮২৬ সাল এই সময়ের মধ্যে ত্রিপুরার মহারাজা রামগঙ্গা মাণিক্যের ( ১৮১৩–১৮২৬ খ্রি. ) সঙ্গে মণিপুরের মহারাজা জয়সিংহের কন্যা চন্দ্ররেখা মতান্তরে চন্দ্রলেখার বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পর আত্মীয়তার সূত্রে অনেক অভিজাত মনিপুরিদের বাসস্থান হয়ে ওঠে এই ত্রিপুরা রাজ্য ( রবীন্দ্র সান্নিধ্যে নবকুমার ও মনিপুরী নৃত্যকলা—হীরেন্দ্র সিনহা/ ত্রিপুরায় রবীন্দ্রনাথ– নিলিপ পোদ্দার, পৌণমী প্রকাশন, আগরতলা ) ।

মহারাজা রাজধর মাণিক্যের পরও বেশ কয়েকজন মহারাজা মণিপুরি কন্যাদের বিবাহ করেছিলেন । ফলে বৈবাহিক সূত্রে বহু মনিপুরি পরিবার ত্রিপুরায় বসবাস করতে শুরু করেন । মহারাজা কাশীচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮২৬–১৮২৯ ),  কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য ( ১৮৩০–১৮৪৯ ),  ঈশানচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৫০৬২ ), বীরচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৬২–১৮৯৬ ), রাধাকিশোর মাণিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯ ), বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য ( ১৯০৯–১৯২৩ ), বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য ( ১৯২৩–১৯৪৭ ), এঁরা প্রত্যেকেই এক বা একাধিক মণিপুরি কন্যাকে রাজমহিষী বা রাজপত্নী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ।

ইতিহাসের এই সমস্ত ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে ধরে নেওয়া যায় যে ঠিক এভাবেই খুব সম্ভবত রানি হরিশেশ্বরীর স্বজন, সেবক ও সেবিকাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরারাজ্যের প্রথম মনিপুরি অভিবাসন কেন্দ্র । রাজধানীর পাশে মেখলিপাড়া গ্রামে । কমপক্ষে চারটি বিভিন্ন বংশের মণিপুরিগণ এখানে বসবাস করছেন । এরা হলেন মরুংবম, হনজবম, খুমনথেম, লাইপুবমনা নামক বংশের উত্তরপুরুষ । রাজকীয় বহরের অন্তর্ভুক্ত না হলে একসঙ্গে একই স্থানে চারটি বংশের মানুষ সমবেত হয়ে বসবাস করতে পারত না । রাজমালা পাঠে জানা যায় যে, বৈবাহিক সূত্রে মণিপুর রাজবংশের সঙ্গে প্রথম সম্পর্কিত হন রাজধর মানিক্য ( ১৬১১ খ্রি.)।  তিনি ত্রিপুরার ইতিহাসে প্রথম রাজধর মাণিক্য । সেই সূত্রে তিনি নিজে ত্রিপুরার নৃপতিদের মধ্যে প্রথম বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন । তিনি সার্বভৌম ও বিরিঞ্চিনারায়ণ নামে পরম বৈষ্ণব পুরোহিত ও ২০০ জন ভট্টাচার্য বৈষ্ণবের সঙ্গে সর্বদা ভাগবত ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করতেন । 
এভাবেই রাজঅন্তপুরে মণিপুরি মহিলাদের আগমনের ফলে মণিপুরি নৃত্য-গীত, কৃষ্টি সংস্কৃতি, বয়নশিল্প, মণিপুরি ভাষা এমনকি মণিপুরি রন্ধনশৈলী ও মণিপুরি খাদ্যাভ্যাসের প্রচলন করেন । মন্দির, মন্ডপগুলিতে  মণিপুরি নৃত্যধারার  বিস্তার লাভ করে । ত্রিপুরারাজ্যের রাজ অন্তঃপুরের বাইরেও প্রসারলাভ করে মণিপুরি নৃত্যশৈলী ।  মহারাজগণের উৎসাহে রাজ অন্তঃপুরের মহিলারা রাজবাড়ির অঙ্গনের মধ্যেই নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান করতেন ।  রাধাকৃষ্ণবিষয়ক ছোটো ছোটো ঘটনা নিয়ে হোলি এবং ঝুলন উপলক্ষে দুইদলে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হত । প্রতিটি নৃত্যই মণিপুরি নৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশন করা হত । মণিপুরি নৃত্যগুরুগণ বিভিন্ন সময়ে  রাজকমারীদের নৃত্যশিক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন । বিশেষ করে রাসোৎসব উপলক্ষে রাজপরিবারের মেয়েরা মণিপুরি 'মহারাস' নৃত্য পরিবেশন করতেন । এককথায় ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে  সেকালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ও ধ্রুপদী নৃত্যের পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল ।

বহু প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরার রাজপরিবারে নৃত্যগীতের একটি সাংস্কৃতিক ধারা বহমান থাকলেও বস্তুতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার মহারাজাদের যোগসূত্র ঘটবার অব্যবহিত পর থেকেই আধুনিক ত্রিপুরার সাহিত্য সংস্কৃতির উন্নতি লাভ করতে শুরু করে । শিল্প ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় । রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ ( ২৭  মার্চ,১৮৯৯ / ১৪  চৈত্র ১৩০৫ বঙ্গাব্দ ) থেকে ১৯২৬ ( ১৩৩২ বঙ্গাব্দ ) খ্রিস্টাব্দ এই ২৮ বছরে মোট সাতবার আগরতলা ভ্রমণে আসেন  । রবীন্দ্রনাথ  ত্রিপুরায়   ১৮৯৯ সালে ২৭ শে মার্চ (১৩০৫ বঙ্গাব্দে ) চৈত্র মাসে বসন্ত শ্রীপঞ্চমীতে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে প্রথমবার আগরতলায় আসেন । তখন কবির শুভাগমন উপলক্ষে শহরের উপকণ্ঠস্থল কুঞ্জবনের শৈলশিখরে কবির সম্মানে বসন্ত উৎসব ও মণিপুরি নৃত্যের আয়োজন করা হয়েছিল । তা দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন । দ্বিতীয়বার কবি আসেন ১৯০১ সালে ( ১৩০৮ বঙ্গাব্দে ) কার্তিক মাসে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে । তৃতীয়বার ১৯০৫ সালে ( ১৩১২ বঙ্গাব্দে ) আষাঢ় মাসে। চতুর্থবার ১৯০৫ সালের কার্তিক মাসে  এবং পঞ্চমবার চৈত্র মাসে । ষষ্ঠবার ১৯১৯ সালে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে কার্তিক মাসে এবং শেষবার তথা সপ্তম বার আসেন মহারাজ কুমার ব্রজেন্দ্র কিশোরের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে ( ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ) ১০ ফাল্গুন । শেষবার যখন কবি আগরতলায় আসেন তখন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে রাসনৃত্যের আয়োজন করা হয় । মনিপুরি নৃত্যের মাধুর্য কবিকে মুগ্ধ ও আপ্লুত করে ।

১৩২৬ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত সিলেট শহরে গুরুদেব গিয়েছিলেন সিলেটবাসীর আমন্ত্রণে । ২০শে  কার্তিক বৃহস্পতিবার অপরাহ্নে সিলেটের নিকটবর্তী 'মাছিমপুর' নামে মনিপুরিদের একটি গ্রামে মণিপুরি শিল্পকর্ম দেখতে যান কবি । গ্রামের মনিপুরিসমাজ গুরুদেবকে অভ্যর্থনা জানায় ছেলেদের 'রাখাল নৃত্য' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে । রাত্রে মনিপুরি বালিকারা নাচ দেখায় গুরুদেবের বাংলোতে এসে । গুরুদেব সেই নাচ দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন । এ সম্পর্কে সুধীরেন্দ্র নারায়ণ সিংহ 'শ্রীহট্টে রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধে লেখেন—

"... রাত্রে মনিপুরী বালক বালিকারা বাংলোতে এসে উপস্থিত হলো কবিকে নাচ দেখাবার উদ্দেশ্যে । নৃত্য আরম্ভ হবার পূর্বে একজন মণিপুরী হারমোনিয়ামে সুর ধরবার উদ্যোগ করতেই কবি তাকে বারণ করলেন । নয়নাভিরাম জাঁকালো পরিচ্ছদ পরিহিত অপূর্ব লাবণ্যমণ্ডিত মণিপুরী বালিকারা তাদের বাহুগুলো নৃত্যছন্দে লীলায়িত করে, বলয়াকারে ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকে তাদের জাতীয়নৃত্য দেখিয়ে তাঁর প্রশংসা অর্জন করল । কবি তাদের নৃত্যে মুগ্ধ হয়ে ২০ টাকা পুরস্কার দিলেন । কথা প্রসঙ্গে এ নৃত্য সম্বন্ধে বললেন, 'graceful best form of physical exercise'. ( কবি প্রণাম, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ২০০২ সিলেট ) ।

১৩২৬ বঙ্গাব্দের ২৩ কার্তিক, রবিবার ( ৯ নভেম্বর, ১৯১৯ ) সিলেট থেকে ফিরবার পথে ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ষষ্ঠবারের মতো আগরতলা সফরে এসেছিলেন । সেবার তিনি স্লেট পাথরের টালিতে ছাওয়া কুঞ্জবন বাংলোতে অবস্থান করেছিলেন । মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে কবির সম্মানে মনিপুরি রাসনৃত্যের আয়োজন করা হয় । সেখানে যাওয়ার জন্য কবি উপস্থিত ব্যক্তিদের বলেছিলেন, ''লালুদের বাড়িতে আজ যাচ্ছি মণিপুরী নৃত্য দেখতে এখুনি ওরা আসছেন । তোমরা তৈরী হয়ে নাও—আমি প্রস্তুত হচ্ছি । দক্ষিণ সমীরণে আজ মাধবীর মধুময় মন্ত্র দিকে দিকে বার্তা পাঠিয়েছে । বসন্তের আগমনে আশার বাণীকে রূপ দিতে হবে ।—তবেই না প্রাণগঙ্গাকে আবাহনের সার্থকতা " 

 সেই সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত এই রাসনৃত্যে ব্রজেন্দ্রকিশোরের কন্যা উত্তরা দেবীও অংশগ্রহণ করেন । সিলেট ও আগরতলায় মনিপুরি নৃত্যশৈলীর বিশেষ লাবণ্যময়তা দেখে কবি শান্তিনিকেতনে মনিপুরি নৃত্য চর্চার উদ্যোগ নেন । ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্যের ছোটো ভাই মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর কবির অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন । শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা প্রবর্তনের কথা চিন্তা করে কবি তখন ত্রিপুরা থেকে একজন অভিজ্ঞ নৃত্যশিল্পীর ব্যবস্থা করতে বললেন ব্রজেন্দ্রকিশোরকে । মহারাজার সঙ্গে পরামর্শ করে মাস কয়েক পরে মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোর রাজপরিবারের  মনিপুরি নৃত্যশিক্ষক রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহকে শান্তিনিকেতনে পাঠালেন মাঘ মাসের প্রথম দিকে  । তার সঙ্গে ছিলেন সহকারি হিসেবে আরেকজন মৃদঙ্গবাদক । শান্তিনিকেতনে ৭-৮ থেকে ১৪-১৫ বছরের ছাত্রদের বেছে নিয়ে বুদ্ধিমন্ত সিংহ নৃত্যশিক্ষণের কাজ শুরু করেন । সেই প্রথম দলটিতে ছিলেন ভবিষ্যতের ভারতবিখ্যাত নৃত্যশিল্পী শান্তিদেব ঘোষ । রবীন্দ্রনাথ তখন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকলকে উৎসাহ দিতেন,  নৃত্যানুশীলন পর্যবেক্ষণ করতেন । শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে প্রতিদিন বিকেলে নাচের ক্লাস হত । শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, 

'কিছু নৃত্যভঙ্গি আয়ত্ত করার পর গুরুদেব তাঁর 'আয় আয়রে পাগল, ভুলবি রে চল আপনাকে' গানটির ছন্দে ওইসব নৃত্যভঙ্গি মিলিয়ে নেবার নির্দেশ দিলেন । বুদ্ধিমন্ত সিংহ গুরুদেবের নির্দেশে গানের সঙ্গে নৃত্যভঙ্গি গুলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে আমাদের শিখিয়েছিলেন । এইভাবে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে গুরুদেবের আগ্রহে প্রথম নিয়মিত নাচ শেখাবার ব্যবস্থা হয়েছিল ।' ( শান্তিদেব ঘোষ : রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য, কোলকাতা ) ।

রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার রাজঅন্তঃপুরে মণিপুরি নৃত্যগীতের যে চর্চা ছিল, সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন । হয়তো এ কারণেই রাজা ও মহারাজকুমার এর কাছে কবি নৃত্যশিক্ষক চেয়েছিলেন । ছেলেদের নৃত্য শিক্ষার সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কবি স্থির করলেন মেয়েদেরও নাচ শেখানোর ব্যবস্থা করবেন । কিন্তু পুরুষ শিক্ষকের কাছে মেয়েদের নাচ শেখা তখনকার দিনে অভাবনীয় ব্যাপার ছিল । তাই রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজকে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৯শে মাঘ এক চিঠি লিখে অনুরোধ করেন—

"মহারাজ বুদ্ধিমন্ত সিংহকে আশ্রমে পাঠিয়েছেন সেজন্য আমরা আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হইয়াছি । ছেলেরা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার নিকট নাচ শিখিতেছে । আমাদের মেয়েরাও নাচ ও মনিপুরি শিল্পকার্য শিখিতে ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছে । মহারাজ যদি বুদ্ধিমন্ত সিংহের স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবার আদেশ দেন তবে আমাদের উদ্দেশ্য সাধিত হইবে । আমাদের দেশের ভদ্রঘরের মেয়েরা কাপড়বোনা প্রভৃতি কাজ নিজের হাতে করিতে অভ্যাস করে ইহাই আমাদের ইচ্ছা । এই জন্য আসাম হইতে একজন শিক্ষয়িত্রী এখানকার মেয়েদের তাঁতের কাজ শিখাইতেছে । কিন্তু সিলেটে আমি মনিপুরি মেয়েদের যে কাজ দেখিয়াছি তাহাই ইহার চেয়ে ভালো । আমি বুদ্ধিমন্তের নিকট আমার প্রস্তাব জানাইয়াছি । সে মহারাজের সম্মতি পাইলে তাহার স্ত্রীকে আনাইয়া এখানকার মহিলাদিগকে মনিপুরি নাচ এবং শিল্পকার্য শিখাইবার ব্যবস্থা করিতে পারিবে এরূপ বলিয়াছে । এই জন্য এ সম্বন্ধে মহারাজের সম্মতি ও আদেশের অপেক্ষা করিয়া রহিলাম ।"

সেদিন শান্তিনিকেতনে নৃত্যচর্চা প্রবর্তনে কবি যে কতটা উৎসাহী ছিলেন তা এই পত্র থেকেই বোঝা যায় ।

কিন্তু বুদ্ধিমন্ত সিংহ বেশিদিন শান্তিনিকেতনে থাকেননি । গ্রীষ্মের ছুটিতে সহযোগীসহ দেশে গিয়ে হয়তো পারিবারিক বা অন্য কোন কারণে তিনি আর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেননি । কিন্তু তাঁর স্বল্পকালীন অবস্থানে তিনি যে নৃত্যশিক্ষাদানের পদ্ধতি ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যান এবং রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন, পরবর্তীকালে মহারাজ বীরেন্দ্রকিশোরের নিকট তাঁর স্বীকারোক্তিতে এর সত্যতা প্রমাণ করে । তিনি বলেছিলেন, প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনের মেয়েরা তাঁর নির্দেশ মতো তাঁর সঙ্গে পদক্ষেপ ও অঙ্গচালন করতে চাইছিল না । রবীন্দ্রনাথ তখন বয়োবৃদ্ধ । তিনিই তখন অগ্রণী হয়ে বুদ্ধিমন্তের নির্দেশ অনুযায়ী অবলীলা ক্রমে নৃত্য শুরু করেন । তখন মেয়েদের লজ্জা ভাঙে । আজকাল উক্ত ঘটনা অভিনব বলেই মেয়েদের নিকট অনুভূত হবে । মনিপুরি নৃত্য তালবদ্ধ ও যৌথ নৃত্য । এই নৃত্যের মাধ্যমে শরীরের আড়ষ্ট ভাব কেটে যায় । ব্যায়াম ও নৃত্যের এক যুগ্ম সাধনায় শরীর সুন্দর ও সুদৃঢ় হয়ে ওঠে । সম্ভবত এটাই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন যদিও পরবর্তীকালে এই প্রচেষ্টা বাদ যায় ।

 এরপর কয়েকবছর শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষা বন্ধ হয়ে যায় । কবি যখন আরেকবার পূর্ববঙ্গ ভ্রমণে যান তখন সেই সুযোগে মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর কবিকে আগরতলায় আসার আমন্ত্রণ জানান । কবি ১৩৩২ সালের ১০ ফাল্গুন, সোমবার ( ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৬ )  সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করেন । পূর্ববঙ্গ সফর শেষে সপ্তমবার তথা শেষবার আগরতলায় আসেন ।এবার ১০ থেকে ১৪ ফাল্গুন কবিগুরু আগরতলার 'পুষ্পবন্ত প্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন' । ১৩ ফাল্গুন সন্ধ্যায় রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে কবি রাসনৃত্যের অনুষ্ঠান দেখেন । মৃদঙ্গ ও মন্দিরা সহযোগে বালিকাদের সমবেত উদ্যোগে পরিবেশিত বর্ণময় এই রাসনৃত্য প্রত্যক্ষ দর্শন করে কবি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি সেখানে স্থির করলেন শান্তিনিকেতনে পুনরায় নৃত্যশিক্ষা প্রবর্তন করবেন । মহারাজাকে অনুরোধ করেন, একজন নৃত্য শিক্ষককে পাঠিয়ে দিতে । এবার মহারাজা রাজপরিবারের আরেকজন নৃত্যশিক্ষক নবকুমার সিংহ ঠাকুরকে পাঠিয়ে দেন । এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "কবি এই নৃত্য দেখিয়া এতই মুগ্ধ হইলেন যে, নৃত্য প্রবর্তনার জন্য নবকুমার সিংহ নামে এক মণিপুরি শিক্ষককে শান্তিনিকেতনের জন্য নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করিয়া আসিলেন ।" নবকুমার এসেছিলেন তার অনুজ বৈকুন্ঠ সিংহকে নিয়ে । বাছাই করা একদল ছাত্রীদের নিয়ে তিনি নাচের প্রশিক্ষণ শুরু করেন । ক্লাস হত আড়ালে শান্তিনিকেতনবাসীদের অগোচরে । সেই সময় বাংলার তদানীন্তন গভর্নর লর্ড লিটন সাহেব শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন । তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয় নবকুমারের শেখানো মনিপুরি নাচের একটি অনুষ্ঠানের দ্বারা । সেদিন মনিপুরি রাসলীলা নৃত্যের কিছুটা অংশ দেখানো হয়েছিল ।

১৩৩৩ বঙ্গাব্দে কবির জন্মদিনে নবকুমারের প্রযোজনায় 'নটীর পূজা' নৃত্যনাট্যের প্রথম সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপন হয় । এটি কবির 'পূজারিণী' কবিতার রূপায়ণ । শান্তিনিকেতনের নৃত্যের ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা ।'নটীর পূজা'র মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে । ছাত্রীরাও তখন নিঃসংকোচে নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে । বুদ্ধিমন্তের সময়ে নাচ শেখার আগ্রহ থাকলেও মেয়েরা এগিয়ে আসতে চাইত না । 'নটীর পূজা'র সময় এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে । ১৯২৭ সালে কলকাতায় পুনরায় অভিনীত হয় 'নটির পূজা' । এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, 'নাটকটির শেষ অংশে ভৈরব রাগিনীতে রচিত 'আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো' গানটির সঙ্গে নন্দলালকন্যা শ্রীমতি গৌরী দেবীর মনিপুরি নৃত্য সহযোগে 'শ্রীমতি'র আত্মনিবেদনের অভিনয় সেদিন শিশু থেকে বয়স্ক দর্শকদের সকলেরই মনে গভীর রেখাপাত করেছিল ।' নৃত্যশিল্পী নটীরূপী গৌরীদেবীর নৃত্যভঙ্গিমার অপূর্ব দক্ষতা সেকালের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল । এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে সম্ভবত, সেই প্রথম উচ্চ ভদ্রবংশীয় কোন মেয়েকে সর্বসমক্ষে নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় । 'নটীর পূজা'তে রবীন্দ্রনাথ প্রথম একটি নৃত্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যা সমগ্র নাটকের মূল সুরটিকে ধরে রাখে । পরবর্তী সময়ে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে রচিত হয় 'তাসের দেশ' ও 'শাপমোচন' যাতে নৃত্যকে আরো বেশি প্রাধান্য দিয়ে সন্নিবিষ্ট করা হয় নাটকে । 'নটীর পূজা'র সময়কালে নবকুমারের জন্যই শিক্ষিত দেশবাসী মনিপুরি নাচের মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারেন বলে শান্তিদেব ঘোষ উল্লেখ করেছেন । প্রভাতকুমার লিখেছেন, "এই নবকুমারের শান্তিনিকেতনে আগমন একটি বিশেষ ঘটনাই বলিব । কারণ এই নবকুমার হইতে শান্তিনিকেতনে  নৃত্যকলা নতুন রূপ পরিগ্রহ করিল, এতদিন পরে যথার্থ নৃত্য শিক্ষক আসিল ।"

 "এইভাবে গুরুদেবের গানের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র নৃত্যপ্রথা নবকুমারের শিক্ষকতায় 'নটীর পূজা'র অভিনয় থেকে শান্তিনিকেতনের প্রথম প্রবর্তিত হয় '' । বলা যেতে পারে নবকুমার শান্তিনিকেতনের মণিপুরি নৃত্যশিক্ষার গোড়াপত্তন করেছিলেন । ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে পৌষ মাসের  (১৯৩১ ) খ্রিস্টাব্দ নবকুমার সিংহ সৃষ্ট মনিপুরি নৃত্যের আঙ্গিকে ও ভীমরাও শাস্ত্রীর সংগীত পরিচালনায় প্রথম শাপমোচন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয় । পরে কলকাতা নিউ এম্পায়ারে, শান্তিনিকেতনে ও সিংহলে এই নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয়েছিল । এরপর মনিপুরি নৃত্যের আঙ্গিকে নবরূপায়ণ রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য 'শ্যামা' পরিবেশন করেন । শুধু যে বিভিন্ন রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যেই মনিপুরি ও অন্যান্য ধ্রুপদী ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের বিভিন্ন মুদ্রা ও শৈলী পরিবেশিত হয়েছে এমন নয় । রবীন্দ্রসংগীত সহযোগে যে সমস্ত নৃত্যের 'কোরিওগ্রাফি' রচনা করা হয়েছে সেখানেও ঠাকুর নবকুমার সিংহের মণিপুরি আঙ্গিকে সৃষ্ট নির্দেশনাকে রবীন্দ্রনাথ যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও মূল্য দিতেন । এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত বিশারদ শান্তিদেব ঘোষ মহাশয় তাঁর লেখনীতে এইভাবে প্রকাশ করেছেন,  'গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি গানের ভাষা, অর্থ, উচ্চারণ, সুরের উঠানামা, লয়, বিস্তার এগুলির প্রতি যত্নশীল ছিলেন' । তাঁর এই কাজে নবকুমার ছিলেন একান্ত আপন । তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নৃত্য সহযোগে এগুলি পরিবেশিত হলে সেসব সৃষ্টি হয়ে উঠত প্রাণবন্ত । বসন্তোৎসব, অভিসার, শারদোৎসব, পূজারিণী এমন অনেক গীতিনাট্যে নবকুমার সিংহের সুচিন্তিত নৃত্যশৈলীর যথার্থ প্রয়োগ আজও   আলোচনার বিষয় হয়ে আছে । সেই রীতি অধ্যবধি রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য চর্চার মধ্য দিয়ে অনুসৃত হয়ে আসছে । 'ঋতুরঙ্গ' নামে আরেকটি সার্থক নৃত্যনাট্যের পরিচালনায় ছিলেন নবকুমার সিংহ । নবকুমার ও মনিপুরি নৃত্য সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ তাঁর 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' গ্রন্থে বলেছেন—

"... নটীর পূজায় মণিপুরি নাচের সম্ভাবনায় উৎসাহিত হয়ে ১৯২৭ সালে গুরুদেব নটরাজ গীতিকাব্যের আসর বসালেন দোলপূর্ণিমার দিনে শান্তিনিকেতনে । কেবলমাত্র তালযন্ত্রের নৃত্যছন্দে নাচ দেখানোর চেষ্টা পরবর্তীকালে 'শাপমোচন'-র অভিনয়ের সময়েই বিশেষভাবে শুরু হয় । মনিপুরি বোলের নাচ দিয়েই তার সূত্রপাত । গানের মাঝে মাঝে ছোট খোলের বোল দিয়ে অভিনয় থেকে কেবল নাচের ছন্দে দর্শকের মনকে একটু আন্দোলিত করাই হল এর কাজ । এটির সূত্রপাত করে যান 'শাপমোচন' এর যুগে (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দ ) নবকুমার সিংহ, যিনি প্রথম নটীর পূজার যুগে মনিপুরি নাচ শান্তিনিকেতনের মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ।... গুরুদেবের গানকে নাচের অভিনয়ে রূপ দেবার তাঁর মত ক্ষমতা আমি আর কোন নর্তকের মধ্যে দেখিনি । এই সময়ে তাঁর সাহায্যে শান্তিনিকেতনের নৃত্যাভিনয়ের ধারা মনিপুরি পদ্ধতিতে প্রভূত উন্নতি লাভ করে ।"

শান্তিনিকেতনের সাফল্যের সূত্রে নবকুমার আহমেদাবাদ, মুম্বাই প্রভৃতি জায়গা থেকে ডাক পেয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯৩৪ এ সদলবলে সিংহলে ( শ্রীলংকা ) যান তখন তিনি নবকুমার এবং তাঁর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন নটীর পূজা এবং শাপমোচন অনুষ্ঠানে তাঁদের যোগদানের জন্য ।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে শারীরিক অসুস্থতার কারণে নবকুমার সিংহ আগরতলার নিজের বাসভবনে চলে আসেন । মনিপুরি নৃত্যধারাকে সারা ভারতবর্ষে জনপ্রিয় করার অগ্রপথিক হিসেবে ইম্ফলের মনিপুরি সাহিত্য পরিষদ ২৩ মার্চ ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ঠাকুর নবকুমার সিংহকে 'নৃত্যগুরু' উপাধিতে ভূষিত  করেন । শিল্পীকে অভিজ্ঞান পত্র ও সম্মানের অঙ্গ হিসেবে কীর্তনের শ্বেতশুভ্র পোশাক ও পাগড়ি দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় । ২১ এপ্রিল ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিভাধর শিল্পী ৮১ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শ্রদ্ধেয় শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, 

"গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ যে নৃত্য ধারার প্রচলন করলেন তার ভিত্তিভূমি রচনা করার সময় নবকুমারকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর সহায়ক হিসেবে । আজ শান্তিনিকেতনের নৃত্যের গৌরবের সঙ্গে তাঁর নাম আমাদের করতেই হবে । আমাদের কাছে তাঁর স্মৃতি কোনদিনই লুপ্ত হবে না ।"

নবকুমারের পর আরো অনেক নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে এসে মনিপুরি নৃত্য ধারাকে অবারিত ও প্রসারিত করে গেছেন । তাঁদের মধ্যে ছিলেন ত্রিপুরা থেকে সাপম বসন্ত সিংহ ও রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ, শিলচর থেকে সেনারিক সিংহ,তদানীন্তন শ্রীহট্টজেলার অন্তর্গত ভানুগাছ থেকে নীলেশ্বর মুখার্জি ( তিনি মনিপুরি ব্রাহ্মণ ) এবং ইম্ফল থেকে হাওবম আতম্বা সিংহ প্রমুখ । তাঁদের মধ্যে অনেকেই শুধু শিক্ষকতায় নয় মনিপুরি নৃত্যের আঙ্গিকে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের অনেক নৃত্যনাট্যের রূপায়ণে সফলতা লাভ করে অবিস্মরণীয় স্মৃতি রেখে গেছেন ।

নব কুমার সিংহের পর যিনি শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষক হিসেবে ত্রিপুরা থেকে গিয়েছিলেন তাঁর নাম নীলেশ্বর মুখার্জি । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের কুলীন ব্রাহ্মণ নীলেশ্বর মুখার্জির জন্মভূমি শ্রীহট্টের ভানুগাছ সংলগ্ন বালিগাঁও । পড়াশোনা শ্রীহট্টের কমলগঞ্জ, ত্রিপুরার কৈলাশহর ও পরবর্তী সময়ে শিলচর । খোলবাদক হিসেবে যৌবনে চারদিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল । ত্রিপুরা-শ্রীহট্ট অঞ্চলে মনিপুরি সমাজে গায়কবাদক হিসেবে নীলেশ্বর তখন এক উজ্জ্বল নাম । একসময় আমন্ত্রণ পেয়ে ত্রিপুরা রাজ দরবারেও তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন । ১৯৩৫ সালে নীলেশ্বর মুখার্জী শান্তিনিকেতনে যোগ দেন । চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম । ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে কাব্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা প্রকাশের ৪৪ বছর পর ১৯৩৬ সালে নবরূপ পায় চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য । কলকাতার অ্যাম্পায়ার থিয়েটারে ১৯৩৬ সালের ১১-১৩ মার্চ চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য প্রথম মঞ্চস্থ করা হয় । রবীন্দ্রজীবনীকার লিখেছেন—

শান্তিনিকেতনের কলাচর্চার আদর্শ প্রচার ও বিশ্বভারতীর শূন্য তহবিল আংশিকভাবে পূর্ণ করা এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল । কবিগুরু ৭৫ বছর বয়সে স্বয়ং অভিনয়ের বিরাট দল নিয়ে উত্তর ভারতে যাত্রা করেন । অভিনয়ের তারিখ ও হলের নাম :– ১৬-১৭ মার্চ– পাটনা, হুইলার সিনেট হল ও এলিফিনিসটোন পিকচার প্যালেস । উনিশ মার্চ– এলাহাবাদ, রিজেন্ট । ২২-২৩ মার্চ– লাহোর,  প্লজ । ২৬-২৭ মার্চ– দিল্লি, রিগাল থিয়েটার । ২৯ মার্চ– মিরাট । ( রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক, চতুর্থ খন্ড ) ।

নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা নাচের ব্যাপারে এক বিশেষ ভূমিকা ছিল নীলেশ্বর মুখার্জির । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহস্পর্শে শান্তিনিকেতনে কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন তিনি । তিনি ছিলেন মণিপুরি নৃত্যের শিক্ষক । এমনকি শান্তিনিকেতনের সেইদিনের ছাত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তাঁর কাছে নৃত্যের তালিম নিয়েছিলেন । ১৯৩৬ সালে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দিয়েছিল । সে সময়ের পত্রপত্রিকায় এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় । নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদার নৃত্য সমাবেশে প্রথমে মনিপুরি শৈলীর প্রাধান্য থাকলেও গৌণভাবে এতে কথাকলি ও অন্যান্য প্রদেশের লোকনৃত্য এবং সেইসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের মিশ্ররীতির ধারা । এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন,

 "চিত্রাঙ্গদা ১৯৩৬ সালে প্রথম যেবার অভিনীত হয় তাতে মনিপুরী পদ্ধতি ছিল প্রধান। তার সঙ্গে সামান্য কিছু কথাকলি, ও লোকনৃত্যের ভঙ্গি মেশানো ছিল । কিন্তু কথাকলির উপযুক্ত শিক্ষক  পাওয়া যাবার পর অর্জুনের অভিনয়ে কথাকলি নৃত্যপদ্ধতি বেশ খানিকটা প্রাধান্য পেল নাচের সঙ্গে  ।'' 
চিত্রাঙ্গদায় যেসব শিল্পী অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন শান্তিদেব ঘোষ, নীলেশ্বর মুখার্জী, গোবর্ধন পাঞ্চাল, শিশিরকুমার ঘোষ, ডি বাল গঙ্গাধর, সন্তোষ ভঞ্জ চৌধুরী, শিবকুমার দত্ত, হীরেন ঘোষ, বিশ্বরূপ বসু, যমুনা দেবী, নিবেদিতা দেবী, মমতা দেবী, হাসু দেবী, দীপ্তি দেবী, ইন্দু দেবী, মনিকা দেবী, রমা দেবী প্রমুখগণ । পূর্ববঙ্গে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থের জন্য ১৯৩৮ সালে মার্চ মাসে শান্তিদেব ঘোষের দায়িত্বাধীনে যে শিল্পীদল গিয়েছিলেন তাতেও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন নীলেশ্বর মুখার্জি ।

১৯৩৫-৩৬ খ্রিস্টাব্দে চিত্রাঙ্গদা প্রস্তুতি পর্বে ত্রিপুরা থেকে আরো একজন নৃত্য শিক্ষক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন তাঁর নাম বসন্ত সিংহ । রাজপরিবারের নৃত্য শিক্ষক ছিলেন তিনি । মহারাজা বীর বিক্রমের রাজত্বকালে রাজধানী, বিশেষত রাজবাড়িতে আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহে বসন্ত সিংহ সফলভাবে নৃত্য ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানা যায় । বসন্ত সিংহ ফিরে আসার পর ত্রিপুরা থেকে অপর একজন নৃত্যশিক্ষক শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন । তাঁর নাম রাজকুমার চন্দ্রজিৎ সিংহ । খাঁটি মনিপুরি শৈলী বজায় রেখে তিনি নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন । শান্তিনিকেতনে চন্দ্রজিৎ যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেন । ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে কবি যখন শেষবারের মতো আগরতলা এলেন তখন ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে প্রতিদিন মনোজ্ঞ মণিপুরি নৃত্য পরিবেশিত হত । সেখানে  রাসনৃত্যানুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়েছিল । রাজকুমার বুদ্ধিমন্ত সিংহের পরিচালনায় রাজঅন্তঃপুরের মেয়েরা এই নৃত্যে অংশ নিয়েছিল । সেদিন ব্রজেন্দ্রকিশোরের বাড়ির নৃত্যানুষ্ঠানে কিশোরবয়স্ক চন্দ্রজিৎ 'আবিরখেলা' নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন । কবি তার নৃত্য দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন । ১৯০৬ সালে বসন্ত সিংহ ফিরে আসার পর শান্তিনিকেতনে মনিপুরি নৃত্যশিক্ষকের বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল । ব্রজেন্দ্রকিশোর তখন চন্দ্রজিৎকে সেখানে পাঠিয়ে দেন । চন্দ্রজিৎ মাত্র দেড়-দুই বছর শান্তিনিকেতনে ছিলেন । মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে চন্দ্রজিৎ শান্তিনিকেতনে কাজে যোগ দিয়েছিলেন । তখন নৃত্যের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মৃদঙ্গ, খুব বেশি হলে সেতার ব্যবহৃত হত । কিন্তু হারমোনিয়াম তবলা কখনো না । 'চিত্রাঙ্গদা', 'তাসের দেশ' ইত্যাদি নৃত্যনাট্যে তাঁর ভূমিকা ছিল । রবীন্দ্রসংগীতের নৃত্যরূপ দিতে তিনি মণিপুরি রাসের 'ভঙ্গিপারেং' মুদ্রাগুলোর সাহায্য নিয়েছিলেন বলে জানা যায় । চন্দ্রজিতের সে যুগের ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন নন্দলাল কন্যা যমুনা, আম্বালাল সারাভাইকন্যা মৃণালিনী, রবীন্দ্রনাথের পালিত কন্যা নন্দিতা প্রমুখ ।

একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে, ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে নৃত্যশিক্ষার জন্য আগরতলা থেকে মনিপুরি নৃত্যশিক্ষক নিয়ে গিয়েছিলেন । ত্রিপুরার রাজানকুল্যের পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাজপরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ থাকার ফলেই তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে মনিপুরি নৃত্যের আন্তর্জাতিক সমাদর বা স্বীকৃতি এসেছে । জহুরি জহর চেনে । 'আজি হতে শতবর্ষ আগে' রবীন্দ্রনাথই চিনেছিলেন এই সম্পদকে । শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায় মনিপুরি নৃত্যের সংযোজন এবং রবীন্দ্রসৃষ্টির সংমিশ্রণে আলোকিত হয়ে মণিপুরি নৃত্য সেদিন বিশ্বের অঙ্গনে স্থান করে নিতে পেরেছিল ।

গ্রন্থঋণ :

১. রবি জীবনী-সপ্তম খন্ড, প্রশান্ত পাল পৃ. ৪৪২
২. রাজপ্রাসাদে মনিপুরী নৃত্য-গীতের চর্চা–( ত্রিপুরার রাজ অন্দর- রাজকুমার জীতেন্দ্রজিৎ সিংহ, ত্রিপুরাবাণী প্রকাশনী, আগরতলা ) পৃ. ১৯–৩০
৩. ত্রিপুরায় মনিপুরী নৃত্যচর্চা, নীলমণি দত্ত, ( ত্রিপুরা প্রসঙ্গ ১৯৭৫ ) পৃ. ১০০-১০১
৪. ত্রিপুরা রাজ পরিবার ও মনিপুরী সমাজ–রাজকুমার কমলজিৎ সিংহ ( উজ্জয়ন্ত ২০০১ )পৃ. ১৪৭
৫. ত্রিপুরায় রবীন্দ্র স্মৃতি–সত্য রঞ্জন বসু ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা ) আগরতলা, পৃ ১–৬
৬. স্মৃতি ভারে পড়ে আছি আমি–নবকুমার সিংহ ( রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা, পৃ. ২৪৫ )  আগরতলা
৭.  গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য–শান্তিদেব ঘোষ, কলকাতা
৮. উত্তর-পূর্ব ভারত ও রবীন্দ্রনাথ ( কোলকাতা ) বিকচ চৌধুরী ।
৯. উত্তর পূর্বাঞ্চল ও রবীন্দ্রনাথ–পান্নালাল রায় ( স্রোত প্রকাশনা ত্রিপুরা ) ।
১০. অন্য রবীন্দ্রনাথ–ড. দেবব্রত দেব রায় ( স্রোত প্রকাশনা ত্রিপুরা )
১১. রবীন্দ্র আলোকে মনিপুরী নৃত্য ও সাহিত্য–নোংথোম্বম কুঞ্জমোহন সিংহ ( প্রবন্ধ ) আগরতলা বইমেলা স্মরণিকা ২০১২-পৃ, ২২- ৩২
১২. চিত্রাঙ্গদা দেশের রবীন্দ্রনাথ–বিকচ চৌধুরী ( প্রবন্ধ ) গোমতী রবীন্দ্রসংখ্যা ২০১০-পৃ. ৭–১৪
১৩. শান্তিনিকেতনের নৃত্য ধারায় ত্রিপুরার ভূমিকা–পান্নালাল রায় ( প্রবন্ধ ) গোমতি রবীন্দ্র সংখা ২০১০পৃ. ১১০–১১১
১৪. মণিপুর ও মণিপুরি–এল বীরমঙ্গল সিংহ, ত্রিপুরাবাণী প্রকাশনী, আগরতলা ।
১৫. রবীন্দ্রজীবন কথা– প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ সংস্করণ ।
১৬. গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য– শান্তিদেব ঘোষ, আনন্দ, কলকাতা ।

No comments:

Post a Comment