Tuesday, December 16, 2025

শঙ্খপল্লব ও দেবব্রত

সম্রাট শঙ্খপল্লব এবং সময় কুকুরের পান্ডুলিপি 

'ভালোথাকার খাসাবাসা'-জবুথবু জীবন, জন্মগহ্বরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের ক্লেদাক্ত ভ্রূণবাস আর হৃদয়হীন সমাজের অবক্ষয়িত শরীর অন্বেষণের বিপরীতে নিরাসক্ত সমাজদৃষ্টি নিয়ে অন্যতর আস্বাদ এনেছেন শব্দের ব্যঞ্জনায় । কবি শঙ্খপল্লব আদিত্য নিজেই বলেছেন, 'আমার শব্দের রন্ধনপ্রণালী আমি আমারই কাছে রেখে দিয়েছি,/একেই কখনো বানিয়েছি রাইফেল কখনো পলির গঙ্গাজল ।' দীর্ণ সময়ের তীক্ষ্ণ শূন্যতায়ও সচেতন থেকে শব্দের তীব্র কটাক্ষে ধ্বস্ত করেছেন ছলজীবনকে । জীবনব্রতে তিনি খুঁজে ফিরেছেন ভালোবাসাকে । ভালোবাসাই তার অন্তর্লোকের গোপন 'যুদ্ধাস্ত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা' । কথা বলার নিজস্ব মুদ্রায় তিনি আমাদেরও বিমূঢ় করে তোলেন । তিনি কবিতায় সম্রাট । কিন্তু তাঁর সংলাপ অস্থির সন্ন্যাসের, যেখানে ঐতিহ্যের ছায়াপাত ঘটে । আলখাল্লার বুননে ভেসে ওঠে রিয়াং পল্লীর নিবিড় টংয়ের সামিয়ানার নিচে, 'অপূর্ব আন্তরিক রমণীয় মানুষের কোমর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বোতল নাচ'-র চারুশৈলী । কবির দিব্যবীক্ষা কতটা গভীরভাবে ছায়া ফেললে এমন লোকপ্রতিম শব্দের চয়ন হয় নিজস্ব বাচনে ! সে তো শঙ্খপল্লবই জানেন । তাঁর চেতনা সীমাবদ্ধতায় বন্দি থাকে না । তির্যক বাক্যবন্ধ হলেও প্রজন্মে প্রবাহিত গাঢ় বিষণ্নতা নগ্ন করে দেখায় তাঁর শব্দবোধ, 'ভেতর ঘরে বিষের গুহা বাইরে কোঁচার ইস্ত্রি ঠাট'-এর ব্যর্থ সওদাগরি । শচীন দেববর্মনের কন্ঠে ভাটিয়ালি গান ছাড়া জীবন অচল হলেও তাঁকে চলে যেতে হয় নির্জন ডোমের শবশকটে । স্বজনের শূন্যে দৃষ্টি ফেলে হা-হুতাস, 'জয় কিংবা পরাজয়' কিছুই কবিকে স্পর্শ করে না । 'লৌকিক কোরাসহীন' বিদায় জানাতেই হল কবিকে । 'ভালোবাসা ও ভালোবাসার' সম্মিলিত হৃদয়ের অর্ঘ্য কবিকে ।

কোলাহল পৃথিবী থেকে দূরের এক দেবশিশু 

কখনও কখনও জাগতিক ঘটনাকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে অসহায় বিস্ময়ে বাকরহিত হতে হয় । এমনটাই হয় যেমনটা মানুষ চায় না ।  কেউ কেউ চলে গেলে মননস্রোত ঘোলাটে হয়ে যায় । কারো কারো কবিতা অসময়ে গেঁথে যায় শেষপাতায় । যোদ্ধাযৌবনকেও হেরে যেতে হয় কখনও বা । অনাকাঙ্ক্ষিত স্তব্ধতা শুধু রেখে যায় সরল দেবশিশুর প্রাণকথা । কবি দেবব্রত চক্রবর্তীর পায়ের ছাপ, কলমের দাগ এমনই অসময়ে থমকে যায় । অথচ তাঁর চেতনা ঘিরে ছিল এই জগতের প্রতি গভীর আসক্তি । আসন্ন সময়কে দৃঢ়তায় মাড়িয়ে দিয়ে জীবনমাধুর্য ছড়িয়ে যান মুখমন্ডলে । তাঁর ঊনজীবনেই তিনি ধরে ফেলতে পেরেছিলেন সমাজের সমূহ অসুখ । 'বাড়ন্ত শৈশব মুক্তমন আবদ্ধ হল / মোবাইল গেইমে, শেয়ার মার্কেট, ট্রেডিং কোডিং আর জুয়ার ইনকামে । দিন শেষে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে হতাশ যৌবন খুঁজে মাদক । / সুস্থ বিনোদন না পেয়ে মানুষ দিন দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে (সমকাল) । সময়ের ভাষায় কবির নিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ জাতগোখরোর পরিচায়ক। সিতরাত অতিক্রমের স্বপ্ন ছিল এই কবির মননচর্চায় । পৃথিবীকে কলুষিত হতে দেখেছেন এই মিতসময়ে । কলুষবিনাশের আহ্বান কবিতায় কবিতায় ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই দিগন্তে বিলীন হয়ে গেলেন দেবব্রত । চিরবিছানায় যাবার আগে তাঁর স্বপ্ন ছিল 'কুঁড়েঘর'কে ঘিরে । স্বপ্ন ছিল এই কুঁড়েঘরে একদিন তৈরি হবে শব্দের স্বপ্নইমারত । স্বপ্নমুখর ছেলেটির প্রস্থানকথা আর স্বপ্নকাঙাল কবির নীরবতা আজ সমার্থক । দুস্তর সাগরের নিকষ অন্ধকারের মধ্যে উপাসনাজীবী কবির মুখরতা অমোঘ মৃত্যুর প্রতীকে ও অনির্ধারিত বাস্তবতায় প্রতিভাসিত । 'চির শায়িত আছো আজ / পুষ্পিত বিছানায় / কোলাহল হারিয়েছ / নিঝুম নিরালায় ।'–হে দেবব্রত, হে কবি, তুমি জেগে থেকো প্রতিবাদ আর বাংলাকবিতায় ।

No comments:

Post a Comment