পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন–বক্সনগরে
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে শৈশব থেকেই শুরু আমাদের পরিযায়ী জীবন । তা থেকে আজও মুক্তি পাইনি । আজ এখানে তো কাল সেখানে । কোথাও থিতু হয়ে বসতে পারলাম না । জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে অতীতের সেই ভাসমান দিনগুলোর কথা প্রায়শই মনে পড়ে । বাবার ছিল বদলির চাকরি । তাই তিনি যেখানে যেতেন সঙ্গে তাঁর পরিবারবর্গকেও নিয়ে যেতেন । ফলে আমাদের সেই দিনগুলোতে ঘরের আসবাব বলতে কিছুই ছিল না । চাকরিতে বদলির সরকারি নির্দেশ আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের রওনা হতে হত পোটলাপুটুলি বেঁধে । একেকবার বদলি হয়ে নতুন জায়গায় গেলেই পেছনে ফেলে আসা সেই ভূমিকে এবং আমার শৈশবের বন্ধু-বান্ধবের কথা বেশ কিছুদিন মনকে খুব নাড়া দিয়ে যেত । যদিও এই অভিজ্ঞতাটা আমার পরবর্তী জীবনের অনেক অমূল্য সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে । আমার সৃষ্টিতেও সেইসব বিষয়গুলো এসেছে । আর এখন জীবন সায়াহ্নে এসে সেই দিনগুলোকে মনে করে এক স্বর্গীয় তৃপ্তি অনুভব করি ।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে আমার বাবা পেচারথল পি এইস সি থেকে বদলি হয়ে বক্সনগর দাতব্য চিকিৎসালয় জয়েন করেন । তখনকার দিনে ছোটো আকারের বাসে চড়ে আমরা প্রথম দিন আগরতলায় আসি । সেখানে একরাত্রি বাসের পর পরদিন সকালে আমরা প্রথমে এসে নামি বিশালগড় বাজারে । সেকালের বিশালগড় বাজার এখনকার মতো এত জমজমাট বা ঝাঁ চকচকে ছিল না । রাস্তার দুপাশে ছোটো ছোটো ছন বাঁশের বেড়ার ঘর ছিল । কোনো কোনো দোকানের গদিটা ছিল বাঁশের মাচার । এমনই একটা তরজার ঝাঁপ ফেলা ঘরে ছিল তখনকার সময়ের বাস সিন্ডিকেটের অফিস । আমাদের বাস এসে সেখানে থামে । আমার মনে আছে বাসটার নাম ছিল 'লাকি দুলু' । বাবা আমাদের বাস থেকে নামিয়ে সিন্ডিকেট অফিসে বসিয়ে রাখলেন । তারপর খোঁজ নিয়ে জানলেন বক্সনগরের রাস্তা কতদূর । একটু এগিয়ে গিয়ে ডান দিক ধরে বাজারের ভেতর দিয়ে বক্সনগরের রাস্তাটা গেছে । তখনকার হিসেবে সিন্ডিকেটের মাস্টার জানালেন বক্সনগরের দূরত্ব প্রায় ১২ মাইল । বাবা ভদ্রলোককে তাঁর পরিচয় দিলেন এবং এই ১২ কিলোমিটার রাস্তা তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে কিভাবে যাবেন সে বিষয়ে দুশ্চিন্তার কথা তাঁকে জানালেন । সেই ভদ্রলোক তখন দৌড়ঝাঁপ করে খোঁজখবর করতে লাগলেন বক্সনগর থেকে মালামাল নিয়ে কেউ এদিকে এসেছে কিনা । তাহলে তাঁদের ফিরে যাবার সময় আমাদেরকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবেন এবং জিনিসপত্রগুলো তাঁরা বয়ে নিয়ে যাবেন । যাই হোক ভদ্রলোকের সহৃদয় প্রচেষ্টার পরে দুজন লোককে পাওয়া গেল । তাঁরা বক্সনগর থেকে মালামাল নিয়ে এখানে এক ব্যবসায়ীর দোকানে এসেছিলেন । কিছুক্ষণ পরে তাঁরা ফিরে যাবেন । সিন্ডিকেট মাস্টার ভদ্রলোকের নির্দেশ মতো প্রায় দশটার দিকে দুই ভদ্রলোক তাদের হাতে মাল বয়ে নিয়ে যাবার বাঁশের বাঁক ও দড়ি নিয়ে অফিসে এলেন । আমাদের কাছে মালপত্র তেমন কিছু নেই । সামান্য যা কিছু ছিল একজন তাঁর হাতের দড়ি দিয়ে বেঁধে বাঁকের দুপাশে ঝুলিয়ে নিলেন । বাবা ও মা হেঁটেই যাবেন । তাঁদের কোলে থাকবে আমাদের ছোটোভাইটি । সমস্যা হল আমরা বড়ো দুইভাইকে নিয়ে । একজনের বয়স ৮ এবং অন্যজন ৬ বছর মাত্র । কিছুতেই ১২ কিলোমিটার পথ আমাদের পক্ষে হেঁটে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয় । এ নিয়ে সবাই ভাবনায় পড়লেন । সে সময় আমাদের নিতে আসা দুজনের একজন একটা উপায় বার করলেন । তিনি আমাদের দুই ভাইকে তাঁর বাকের দু'পাশে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে বসার ব্যবস্থা করতে পারলে আমাদের বয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে জানালেন । আমাদের পোটলাপুটলির মধ্যে সম্বল ছিল দুটো কাঁঠালকাঠের পিঁড়ি । মা বস্তার ভেতরে রাখা পিঁড়ি দুটো বের করে তাদের দিলেন । ভদ্রলোক আমাদের দুজনকে দুটো পিঁড়িতে বসিয়ে তাঁর কাঁধের বাঁকে ঝুলিয়ে রওনা দিলেন । এভাবেই আমরা দুই বিচ্ছু ভাই 'পালকি চলে পালকি চলে / গগন তলে আগুন জ্বলে' ছড়াটি বলতে বলতে বাকের দুলনির সঙ্গে দুলতে দুলতে বক্সনগর চললাম । কিন্তু আমাদের চঞ্চল নড়াচড়ায় বাহক ভদ্রলোকের ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল । তিনি মাঝে মাঝে আমাদের ধমক দিচ্ছিলেন ।
এভাবে পথে বেশ কয়েকবার জিরিয়ে নিয়ে আমরা বিকেল চারটার দিকে বক্স নগরে এসে পৌঁছাই । সে সময় বক্সনগর দাতব্য হাসপাতালটি বাজারের একেবারে শেষপ্রান্তে নিবারণ সাহার বাড়ি ও দোকানের লাগোয়া ছিল । নিবারণবাবুর বাড়ির পরেই টিলাটা শেষ এবং ঢালু বেয়ে ছরার দিকে চলে গেছে । ওপারে বক্সনগর স্কুল মাঠ ও পুণ্যমতি গ্রাম । হাসপাতালের পেছনে একটি তরজার ছাউনি ও বেড়ার ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল । পাশের নিবারণবাবুর বাড়ির সদস্যরা এসে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেলেন এদিন আর রান্নাবান্না না করার জন্য মাকে অনুরোধ করে গেলেন এবং রাত্রিতে তাদের ঘরে অন্নগ্রহণের আমন্ত্রণ করলেন । সেই থেকে এই পরিবারটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় শুরু এবং যতদিন আমরা বক্সনগর ছিলাম ততদিন তাঁদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল । এই পরিবারের বড় দাদাটির নাম ছিল সম্ভবত বিভূতি । তারপরে কানুদা তারপরে সম্ভবত নারায়ণ ও বিজয় । আমার ভুলও হতে পারে । সবার নাম এখন আর মনে পড়ছে না । কানু সাহা অর্থাৎ কানুদা আমাদের চেয়ে বড়ো । তিনি আমাদের ছোটো ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন । এই দিনেই কিছুক্ষণ পরে এসে দেখা করে যান ডাক্তারবাবু হরেন্দ্র চক্রবর্তী । প্রায় আমার বাবার বয়সী তিনিও সপরিবারেই বক্সনগরেই থাকেন । পরদিন এই কানুদার সঙ্গেই আমি ও আমার ভাই অসীমানন্দ বক্সনগর স্কুলে যাই ভর্তি হওয়ার জন্য । ছোটোভাই বিবেকানন্দ তখন কোলের শিশু । দেড় বা দুবছর বয়স । বাবার ডিসপেনসারির সময় থাকায় আমাদের সঙ্গে যেতে পারেননি । তবে সকালবেলায় স্কুলের শিক্ষক মহাশয়দের সঙ্গে তাঁর এক প্রস্থ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল । তাঁরাই আমাদের স্কুলে যেতে বলেছিলেন । ধীরে ধীরে স্কুলে আমরা সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকি । যেহেতু আমরা উত্তর ত্রিপুরা থেকে এসেছিলাম তাই আমাদের কথায় একটা সিলেটি টান থাকত । এখানকার মানুষের মুখের ভাষায় ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার টান । ফলে ছোটো বয়সে যা হয়, আমাদের দুই ভাইয়ের কথাবার্তা নিয়ে সহপাঠীরা মশকরা করত । ধীরে ধীরে আমরা তা কাটিয়ে উঠি । আমার সঙ্গে যারা পড়ত তার মধ্যে যতটুকু মনে পড়ে কানুদাদের কোনো এক ভাই নারায়ন বা বিজয়, বিভীষণ বণিক, নিখিল দাস, আবু তাহের, মোখলেসুর রহমান, আব্দুল মোনাফ, সুবোধ নাথ, অমূল্যরতন পাল, ফটিক মজুমদার এবং ডাক্তারবাবুর ছেলে অজিত চক্রবর্তী । ডাক্তারবাবুর বড়ো ছেলে রঞ্জিত আমার একক্লাশ উপরে ছিল । এর মধ্যে আবার ফটিক ভৌমিক ওরা আমাদের পারিবারিক আত্মীয় । ফটিকের বাবা বক্সনগর তহশীল অফিসের তহসিলদার ছিলেন । ফটিকের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার সূত্র হলো রাজ্যের একসময়ের বিশিষ্ট সাঁতারু রতনমণি রায়চৌধুরী ছিল তার মাসি এবং রতনমণি রায়চৌধুরী সম্পর্কে আমাদের পিসি হন । এই পিসিদের বড় ভগ্নিপতি ফটিকের মা । ফটিকরা তহশীল অফিসের পিছনে সরকারি কাঁচাঘরে থাকত । সুবোধের বাবা ছিলেন চিকিৎসক । বক্সনগর বাজারে তার ওষুধের দোকান ছিল । বিভীষণের পরিবার সদ্য পাকিস্তান থেকে উঠে আসে । তার দাদা নারায়ণ বণিক বাজারে একটি বাজে মালের দোকান শুরু করেন । আবু তাহেরের বড়ো ভাই বক্সনগর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন (তাঁর নামটা এখন আমার আর মনে নেই) । তবে তাঁদের সম্পর্কে একটা ঘটনা এখনো আমার মনকে নাড়া দেয় । অমূল্যরতনরা পরে এখান থেকে চলে গিয়ে আমবাসা বাড়ি করে । কুলাই থাকাকালীন তার পঙ্গে আমার দেখা হত ।
শিক্ষক মহাশয়গণ ছিলেন খুব আন্তরিক । স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তাঁরা আমাদের প্রতি খুব যত্ন নিতেন । প্রধানশিক্ষক ছিলেন নলিনীকান্ত আচার্য । এছাড়া অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন বর্ষীয়ান প্রফুল্ল কুমার আচার্য, গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস, তাজুল ইসলাম স্যর, চিত্ত রায়, গুপ্ত স্যর, শাজাহান স্যার এবং রমেশ দাস । আমরা বিদ্যালয়ে পাঠকালীন সময়ে রমেশ দাস স্যার ট্রেনিং নেওয়ার জন্য কাঁকড়াবন চলে যান । কিন্তু কিছুদিন পরেই তাঁর বোধহয় কোনো মানসিক সমস্যা হয় এবং তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন বলে জানা যায় । শৈশবের সেই ঘটনাটি আমার মনে খুব নাড়া দিয়েছিল । এরকম আরো একটি প্রশ্নবোধক ঘটনা আজও আমার মনে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে । আমাদের বন্ধু আবু তাহেরের দাদা (তার নামটা আমার মনে নেই) আমাদের শিক্ষক ছিলেন । তিনি এবং শাহজাহান স্যার একসঙ্গে চলাফেরা করতেন । হঠাৎ একদিন আমরা শুনতে পাই এই দুজন স্যারের চাকরি চলে গেছে কোন এক অজ্ঞাত কারণে । দুজন শিক্ষকই ভীষণ ছাত্রবৎসল ছিলেন । তাছাড়া শাজাহান স্যারের বড় মেয়ে সম্ভবত বিউটি নাম আমাদের একক্লাশের সিনিয়র ছিল এবং আমাকে খুব স্নেহ করত । একেবারে সীমান্ত সংলগ্ন তাদের বাড়িতে গিয়ে শৈশবে আমি বড়ই গাছ থেকে বড়ই পেড়ে খেয়েছি । তাঁদের হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়া ব্যাপারটা আজও আমার মনে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করে ।
বক্সনগরে সে আমল থেকেই হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত বসবাস । গ্রামবাসীদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ছিল আন্তরিক সম্পর্ক । চিকিৎসায় সুফল পাওয়ার সুবাদে অনেক মুসলমান বয়স্ক মহিলা ও পুরুষ আমার বাবাকে আব্বা এবং মাকে আম্মা বলতে দেখেছি । তারা বয়স্ক হলেও আমাদের ভাইদের ভীষণ আদর করতেন । তাঁদের কেউ কেউ বাড়ি থেকে দুধ, খেতের ফসল, খেজুরের গুড় ইত্যাদি নিয়ে আসতেন । বাবা বকাঝকা করলেও গোপনে মার কাছে গছিয়ে দিয়ে যেতেন ভাইদের খাওয়ানোর জন্য । আজ কারোর নাম মনে নেই । চেহারাও মনে নেই কিন্তু সেদিনের কথাগুলো মনে পড়লে আজও হৃদয়ের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে । তখনকার মানুষের মধ্যে কোনরকম ভেদাভেদ ছিল না আন্তরিকতা ছিল প্রচুর ।
ছোট্ট বক্সনগরে সে সময়ে দুর্গাপূজা করতেন ধীরেন্দ্র সাহা নামে এক তরুণ ব্যবসায়ী । তাঁরা অল্প কিছুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে এখানে এসে বসতি ঘরে ছিলেন । সেখানকার বর্ধিষ্ণু পরিবার এখানে জমিজমা বদল করে আসায় তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল খুবই । তাঁদের সঙ্গে তাঁদের গ্রামের এবং আত্মীয়স্বজন অনেকেই বক্সনগর এসে এভাবে বসতি করেছিলেন । ফলে দেশ বাড়ির সম্পর্কের বাঁধনটা রয়ে গিয়েছিল । ধীরেন্দ্রবাবুর ভাই সুনীল সাহা শিক্ষক ছিলেন । বড় ভাই তাঁকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়েথা করিয়েছিলেন । আমরা সেই বিয়ের নিমন্তন্ন খেয়েছিলাম । পুজোর সময় ধীরেন্দ্র সাহার বাড়িতে গ্রামের সব মানুষ অংশগ্রহণ করতেন । একবার পুজোর সময় ধীরেন্দ্র সাহার বাড়িতে কোন একটা অশৌচকালীন সংস্কার পালনন চলছিল । অশৌচের মধ্যে দুর্গাপুজো করার নিয়ম নেই । তখন তাঁর প্রতিমা তৈরি প্রায় শেষ । সে অবস্থায় তিনি আমার বাবার উপর পুজোর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন । ধীরেন্দ্র সাহা নিজেই প্রতিমা গড়তেন । তাঁর প্রতিমা ছিল সাবেকি ধরনের । একবার তিনি বড়ো কাঠামের পাশাপাশি ছোটো আকারের একটি দুর্গামূর্তি গড়েন এবং সেই মূর্তির সামনে পূজারত রামচন্দ্রেরও একটি মূর্তি করেছিলেন । বাজারের উপরে বাচাই ঘরেই তিনি মূর্তি করতেন আমরা স্কুলে যাওয়া আসার সময় বেশ কিছুটা সময় তার মূর্তি নির্মাণকৌশল অবাক হয়ে দেখতাম । বাজারের একপাশে সবসময় একটি রথ দাঁড়ানো থাকত । রথের সময় এটা টানা হত । তারও উদ্যোক্তা ধীরেন্দ্র সাহাই । পুজো করার পাশাপাশি ধীরেন্দ্র সাহা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও জড়িত ছিলেন । পুজোর সময় তাঁর উদ্যোগে যাত্রা অনুষ্ঠান হত । সেই যাত্রাপালায় তখনকার সময়ে বক্সনগরের থানা তহসিল, স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য সরকারি অফিসের কর্মচারীগণসহ বক্সনগরের বিশিষ্ট হিন্দু-মুসলমানগণ অংশগ্রহণ করতেন । তখনকার সময়ে প্রায় সারারাত ধরেই যাত্রাপালা হত । 'শেষ নামাজ' নামে একটা যাত্রাপালার কথা আমার এখনো মনে আছে । এছাড়া পৌরাণিক যাত্রাপালাও তাঁরা করতেন । সেই যাত্রাপালায় আমার বাবা একবার সূর্যদেবের ভূমিকায় অংশগ্রহণ করেছিলেন । বক্সনগরে শ্রাবণমাস জুড়ে মনসামংগলের গান বা পদ্মাপুরাণ পাঠ হত প্রায় প্রতি বাড়িতে । এ গ্রামে দু তিনটে মনসামঙ্গল পাঠের দল ছিল । পাঁচনাইল্লা থেকে একটা মনসামঙ্গলের দল আসত । পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত্রে হত বেড়ার ঘর তৈরি এবং সেখানে রাত্রিবাস ও বনভোজন । ভোরবেলা স্নান করে সেই ঘরে আগুন দেওয়া হত এবং সুর করে ছেলেরা নানারকম ছড়া আওড়াত । বাজারের টিলাটার এক প্রান্তে থানা অবস্থিত হওয়ায় এর নাম ছিল থানার টিলা । আর উল্টোদিকে ছড়ার ওপারে গ্রাম হল পুণ্যমতি । সংক্রান্তির দিন ভোরবেলা দুই পাড়ের ছেলেরা একে অন্যকে উক্তি করে ছড়া কাটত এই বেড়ার ঘর পোড়ানোর সময় । তেমন একটি ছড়া এখনো আমার মনে আছে । যেমন থানা টিলার ছেলেরা বলত, 'গাঙ্গে দিয়া ভাইস্যা গেল আইট্টা কলার থুর, / হগল গাঁইয়ায় সাক্ষী আছে পুণ্যমতি চুর' । সেরকম পুণ্যমতির ছেলেরাও ছড়া কেটে উল্টো থানার টিলার দোষারোপ করত । বসন্তে দোলপূর্ণিমায় হত দোল উৎসব । ধীরেন্দ্র সাহার বাড়িতে দোল ও ঝুলন দুটোই পালিত হত । দোলের সময় হোলির গান গেয়ে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে সবাই রঙের উৎসবে মাততেন । সেকালে থানার একজন দারোগা ছিলেন যিনি নাকি ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সদস্য । তাকে সবাই কর্তা বলে ডাকতেন । তিনি খুব সুন্দর হোলির গান গাইতে পারতেন । গানের দলে তিনি ছিলেন মধ্যমণি । চৈত্র সংক্রান্তিতে বাজারের উল্টোদিকে হরিমঙ্গল ছরার ওপারে ধান খেতে হত চড়ক গাছঘুরানি । একে কেন্দ্র করে হত প্রচুর লোকসমাগম ও মেলা বসত । তখনকার সময়ে বাজারের আশেপাশে বসতির মানুষের স্নানের ও পানীয়জলের উৎস ছিল এই হরিমংগল ছরা । কিছুদূর গিয়ে ছরাটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে । ছরাটিতে সেকালে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত । ছোটোদের সাঁতার ও জলকেলির স্থান ছিল এই ছরা । বর্ষাকালে স্রোতের বেগও ভীষণ বেড়ে যেত ।
বক্সনগর দাতব্য হাসপাতালে আমার বাবার সহকর্মী একজন ছিলেন শচীন্দ্র চক্রবর্তী । সে সময়ে বয়সে তরুণ শচীন্দ্র মামা এলাকার সবার প্রিয়পাত্র ছিলেন । তিনি তাঁর কারিগরি জ্ঞানের সহায়তায় পুরোনো রেডিওর স্পিকার খুলে মাইক্রোফোন বানিয়ে সেসময়ের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পর্কে বাজারে ঘোষণা দিতেন এবং তিনি নিজেও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন । বক্সনগর স্কুলেও ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা হত । গোডাউনটি তখন খোলামেলা ছিল । নাট্যানুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সেখানে হত ।শিক্ষকদের মধ্যে গৌরাঙ্গ স্যার এসব ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতেন । অন্য শিক্ষকরা তাঁকে সহায়তা করতেন । ছোটো ছেলেরা খেলাধূলার মধ্যে লাডুমখেলা, গুল্লি খেলা, দাগ্গি খেলা, পিছলাগুটি দিয়ে বন্দুকবাজিসহ কাবাডি, ফুটবল, দাইরাবান্দা ইত্যাদি নিয়ে মেতে উঠত । বক্সনগর মাঠে বড় ফুটবল খেলার ম্যাচ হত । এই ম ঠের পাশে একবার একটি বাঘ মারা পড়েছিল । আমরা গিয়ে দেখি কিছু মানুষ তার চামড়া সংগ্রহ করছে ।
সেকালে সবার মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক ছিল । মাঝে মাঝে বনভোজন হত সবাই মিলে । ১৯৬৪ সালের মে মাসে গরমের ছুটিতে সবাই মিলে বনভোজনের আয়োজন হয় । উদ্যোক্তা ছিলেন অলরাউন্ডার শচীন্দ্র মামা । সবাই মিলে জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হই ভেলুয়ার চর । সঙ্গে বিনোদনের সরঞ্জাম হল রেডিও এবং গ্রামোফোন । রান্নাবান্নার উদ্যোগ চলছে । হঠাৎ রেডিওতে ভেসে এল দুঃসংবাদ । প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রয়াত হয়েছেন । কিসের বনভোজন কিসের কি ! সবাই শোকাহত । স্থগিত হয়ে গেল বনভোজন । সবাইকে ফিরে আসতে হল । দিনটি ছিল ২৭শে মে । সেটাও আমার মনে থাকবে চিরদিন ।
বক্সনগরের চারদিকে সে সময়ে প্রচুর খালি জায়গা ছিল । এই থানার টিলার উপরে যেখানে একটি বড়ো গোডাউন আছে তার পাশের লুঙ্গাটি লম্বালম্বি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত । একদিকে ছরা ও তার পাশের রাস্তা আর অন্যদিকে থানার কোয়ার্টার্স পর্যন্ত ছিল তার বিস্তৃতি । গোডাউনটার ঠিক পাশেই এই লুঙ্গার মধ্যে বন কেটে এখান থেকে ছনবাঁশ সংগ্রহ করে আমরা এবং ডাক্তারবাবুর পরিবার দুটি ছনের বেড়া ও ছনের ছাউনি দেওয়া ঘর তৈরি করে পাশাপাশি বসবাস করতাম । ছনের বেড়া গোবর মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া হত । তাতে আর ফাঁকফোঁকর থাকত না এবং শীতকালে ঠান্ডাও লাগত না । ঘরের পাশেই ছিল দুটি বড়ো বড়ো কাঁঠালগাছ । প্রচুর কাঁঠাল ধরত । খুব সুস্বাদু কাঁঠালগুলি আমরা খেয়ে শেষ করতে পারতাম না । বাড়ির আশেপাশে খেতকৃষি করার মতো প্রচুর খালি জায়গা ছিল । আমাদের দুই পরিবার সেখানে যার যার প্রয়োজনীয় ক্ষেতের ফসল ফলাতাম । ফলে কাঁচা তরিতরকারি আমাদের কিনতে হত না । সেসময় এ অঞ্চলে ছিল প্রচুর খেজুরগাছ । আমাদের বাসস্থানের পাশেই ছিল বেশ কিছুটা জমি । সেখানে স্থানীয়রা চাষ করতেন । জমি পেরোলেই টিলা । সেখানে ছিল প্রচুর আম, জাম ইত্যাদি ফলের গাছ । জমিতে চাষ দেওয়ার সময় জমির মালিকরা আমাদের ডাকতেন । কারণ তাঁদের হালের বা মইয়ের পেছনে হাঁটলে সেসময় প্রচুর নানা ধরনের ছোটোমাছ, কাঁকড়া ও ছোটো কচ্ছপ পাওয়া যেত । আমরা সেই মাছ সংগ্রহ করে আনলে মা রান্না করে দিতেন । তখনকার সময়ে খেতে পাওয়া সেই মাছের কি অপূর্ব স্বাদ ছিল ।
বক্সনগরের অধিকাংশ হিন্দুরা সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে উঠে এসে এখানে বসতি গড়ছেন । কেউ কেউ দেশের জমিজমা বদল করে এসেছেন । কেউবা কপর্দকশূন্য অবস্থায় উঠে এসে নতুনভাবে জীবন গড়ার প্রয়াস নিচ্ছেন । মুসলমানরা ছিলেন প্রাচীন বাসিন্দা এবং তাঁরা বর্ধিষ্ণু ও সম্পদশালী ছিলেন । কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল বাজারে বিক্রি করার জন্য আনতেন । তখনকার সময়ের জিনিসপত্রের দর ছিল খুবই কম । মেট্রিক পদ্ধতিতে পরিমাপ তখনো সেই বাজারে চালু হয়নি । চালের সের ছিল চার আনা । তাও অনেকের কেনার সাধ্য ছিল না । এই চালের সের যেবার চার আনা থেকে পাঁচ আনা হল সেবার বাবা ও অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠরা বলাবলি করতে শুরু করলেন যে ছেলেমেয়েদের আর বাঁচাতে পারবেন না । ছোটোমাছ বড়জোর আট আনা সের । রুই, কাতলা, কালিবাউশ ২ টাকা সের । শিং-মাগুরের দর আট আনা বেশি থাকত । যে কোনো শুঁটকি ১ টাকা সের । তবে নোনা ইলিশ চোরাই পথে পাকিস্তান থেকে আসত । তার সের ছিল ২ টাকা । ডিমের হালি দু আনা । কাঁচা সবজির মধ্যে আলু, মূলো, ঝিঙে, ধুন্দুল, ঢেঁড়স ইত্যাদির সের চার পাঁচ পয়সার বেশি ছিল না । আম জাম কাঁঠাল পেয়ারা কলা বেল ইত্যাদি কোন ফলই বাজারে বিক্রির চল ছিল না । প্রতি বাড়িতেই নানা ফলের গাছ ছিল । কারো বাড়িতে না থাকলেও অসুবিধে ছিল না । একে অন্যের বাড়ি থেকে চেয়ে চিনতে নেওয়া যেত । শীতকালে আট আনা সের প্রচুর খেজুরের রাব বা লালি পাওয়া যেত । খেজুরের রস ছিল পাঁচ পয়সা সের । বাজে মালের মধ্যে ডাল আট আনা/দশ আনা, দেশলাই বাক্স ৫ পয়সা চারমিনার সিগারেট ১২ পয়সা প্যাকেট, কেরোসিন তেল কুড়ি পয়সা, সাদা কাগজ চার আনা দিস্তা, ব্রিটানিয়া থিন এরারুট ১০ পয়সা প্যাকেট, ছোটো বিস্কিটের প্যাকেট ৫ পয়সা, চকলেট প্রতিটি এক পয়সা ।
এত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও রাত নেমে এলেই বক্সনগরের বুকে ছড়িয়ে পড়ত অজানা আতঙ্ক । সেসময়ে প্রতিরাতেই বক্সনগরে ডাকাতি হত । পাকিস্তান থেকে সশস্ত্র ডাকাতদল এসে এপারের জনপদে ডাকাতি করত । পেছনে ইপিআরের ইন্ধন থাকত । রাত নামলেই গৃহস্থরা ঘরের দরজা জানালা শক্তপোক্ত করে বেঁধে রাখত । অনেকসময় গোয়ালঘরের গোরুগুলিকেও নিজেদের থাকার ঘরে নিয়ে আসত । তারপরেও রেহাই ছিল না । ডাকাতদল সঙ্ঘবদ্ধভাবে ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গৃহস্থের বাড়ি আক্রমণ করত এবং তাদের ধনসম্পদ ও গবাদি পশু লুঠ করে নিয়ে যেত । টের পেলে গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রতিরোধও হত এবং ঢাকার দলের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটত প্রায়শই । গ্রামবাসীর হাতে একবার এক ডাকাত মারা পড়েছিল । তার লাশ বাজারের বাচাইতে এনে ফেলে রাখা হয় । তখনকার সময় ঝড়ের খুব তান্ডব হত । পাকিস্তান থেকে উঠে আসা মানুষজন আর্থিক দুরবস্থার কারণে তেমন মজবুত ঘর করতে পারতেন না । চৌষট্টি সালে পুজোর আগে বিধ্বংসী ঝড়ে গ্রামে বহু বাড়িঘর বিধ্বংসী ঝড়ে ভূপতিত হয়ে গিয়েছিল । আমরাও অন্যান্যদের সঙ্গে তখনকার তহশিল কাছারির দালানে আশ্রয় নিয়েছিলাম । সারারাত তান্ডবের পর ভোরের দিকে ঝড় থামে । বাইরে বেরিয়ে মনে হয় যেন প্রলয় হয়ে গেছে চারদিকে । এছাড়া সাপের ও বিষাক্ত কীটের ভীষণ প্রাদুর্ভাব ছিল । এখন যেখানটায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য হয়েছে সেটা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং সাপ, গুইল, বনরুই আর সজারুর আড্ডা । সেইসঙ্গে মনসমঙ্গলবিষয়ক কিংবদন্তী জড়িয়ে থাকায় মানুষ ভয়ে সেদিকে যেতই না ।বাড়িঘরে প্রায়ই সাপ ঢুকে পড়ত । খেলার সময় আমরো ছোটোরা একবার একটা কেউটে সাপ মেরেছিলাম ।
৬৫ সালে আবার বাবার বদলির কাগজ আসে । বাবা বক্সনগরে থাকাকালীন সময়ে যে সুনাম অর্জন করেছিলেন তার দরুন এলাকার মানুষ তাঁকে ছাড়তে চাইছিল না । ফটিকের বাবা তহশীলদার হওয়ার সুবাদে আমরা যে জায়গাটায় ঘর করে থাকতাম তা বাবার নামে বন্দোবস্ত করে দেওয়ারও প্রস্তাব দেন তিনি । গ্রামের বিশিষ্টজনেরা দরবার করে বাবার বদলি রদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিকূলতার কারণে এবং অনবরত ডাকাতির ভয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার চিন্তায় এই বদলি মেনে নেন । কিন্তু পরবর্তীকালে বাবা কোনো সংকটপূর্ণকালে বক্সনগরের দিনগুলোর কথা প্রায়ই স্মৃতিচারণ করতেন । বলতেন, বক্সনগর ছাড়া তাঁর ভুল হয়েছিল । আমরা তখন তো নেহাতই ছোটো । ভালোমন্দের কিইবা বুঝি । আমরা যেদিন হাঁটাপথে বক্সনগর ছাড়ি সেদিন বহু অশ্রুসজল মানুষ আমাদের পেছনে পেছনে অনেকদূর এসেছিলেন । বাবা তাঁদের বারবার আর না আসার জন্যে অনুরোধ করছিলেন । আগেরদিন আমরা দুভাই স্কুলে গিয়ে সব ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করি ও শিক্ষকমহাশয়দের প্রণাম করি । ক্লাসে আমার সব বন্ধুদের দেখা পাই । তাদের একটি করে কলম উপহার দিয়েছিলাম সেদিন । তবে সেদিন আমার প্রিয়বন্ধু ক্লাসের প্রতিদ্বন্দ্বী নিখিল স্কুলে আসেনি । তারপর সারাজীবন তাকে খুঁজে ফিরেছিলাম । বক্সনগরের কাউকে পেলেই তার কথা বলতাম । একবার জানলাম রাজ্যের এক গুণী ব্যক্তিত্ব স্বপনকুমার দাসকে । বক্সনগরের সন্তান জেনে তাঁকে কথাটা জানিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় লিখতেই নিখিলের আবির্ভাব ঘটে । তারপর দুজনে বহু কথা হয় অনলাইনে। কদিন আগে সন্ধ্যায় বটতলায় ও আমাকে দেখে চিনে ফেলে । নিখিল ওর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ দেয় । আমি বারবার কথার খেলাপ করি । আমার এই স্মৃতিচারণমূলক লেখা নিখিলের ক্রমাগত চাপেই লেখা ।
No comments:
Post a Comment