Wednesday, December 31, 2025

বেগম খালেদা জিয়া : গৃহবধূ থেকে দেশের কর্ণধার

বেগম খালেদা জিয়া : গৃহবধূ থেকে দেশের কর্ণধার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

মনে পড়ছে একাত্তরের ঝড়ো দিনগুলোর কথা । ওপার বাংলায় তখন নতুন দিগন্তরেখা । ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হচ্ছে রক্তিম আলোকচ্ছটায় । স্বাধীনতাকামী আকিশোর-বৃদ্ধ-বণিতা নেমে পড়েছে রাজপথে । ২৫ শে মার্চের পর থেকে সে আন্দোলন আরো সংগঠিত রূপ নেয় । সেদিন আমাদের এই সাব্রুমের অপর প্রান্তে ফেনীনদীর দক্ষিণ পাড়ে রামগড় হাইস্কুলের মাঠে চলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ । প্রশিক্ষণের নেতৃত্বে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান । এক দীর্ঘ সময় রামগড়কে পাক হানাদারমুক্ত রেখে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন । 

একসময় পাকবাহিনী রামগড় দখল করে নিলে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী চলে আসেন সাব্রুম ।সাব্রুমের হরিনা গ্রামসংলগ্ন গরিফা অরণ্যভূমিতে । করা হয় মুক্তিফৌজের ক্যাম্প ও একনম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার । প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । এখানেও তিনি যুবকদের একত্রিত করে ট্রেনিং পরিচালনা করতেন । তারপর মুক্তিবাহিনীকে পাঠাতেন দেশের অভ্যন্তরের লড়াই করার জন্য । এক নম্বর সেক্টরের সবগুলো সাব-সেক্টরের মধ্যে সাব্রুমের শিলাছড়ি, ঘোড়াকাঁপা থেকে শুরু করে ঋষ্যমুখ, মতাই পর্যন্ত তিনি চরকির মতো ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করতেন । রণকৌশল নির্মান করতেন । রণাঙ্গনের নেতৃত্ব দিতেন । কখনো দিনে বা রাতে খেতে আসতেন সাব্রুম-ছোটখিল রোডের মুখে বাঁ-পাশে মাখন দে-র হোটেলে ।

সারাক্ষণ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন এই উচ্চপদস্থ সেনানায়ক । এতকিছুর মধ্যেও তাঁর মনে সুখ ছিল না এতোটুকু । তিনি সংবাদ পেয়েছেন তাঁর সহধর্মিনী বেগম জিয়া ও দুই প্রাণপ্রিয় সন্তান ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বন্দি অবস্থায় আছেন । তিনি চঞ্চল হয়ে উঠলেন । নানাভাবে তিনি খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন । খবর পেলেন ২রা জুলাই ঢাকা সিদ্ধেশ্বরীর এক বাসা থেকে পাক সেনারা বেগম জিয়াকে তার দুই সন্তান সহ ধরে নিয়ে গেছে । ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট ২৪ বছর বয়সে যখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন ছিলেন । তখন মাত্র ১৫ বছরের কিশোরী খালেদাকে বিয়ে করেন । এর মধ্যে তাঁদের দুটি সন্তান আসে । মাত্র ১০-১১ বছরের দাম্পত্যজীবন  সেসময় । স্ত্রী ও পুত্রগণের বন্দী হওয়ার সংবাদে তিনি আরো মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন । ধ্বংস করছিলেন একের পর এক পাকঘাঁটি । বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণাঞ্চল মুক্ত রাখা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্ট্র্যাটেজিক সুবিধা এনে দিয়েছিল ।

 ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন । ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি পান । বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ১৯৮১ সালে যখন হত্যা করা হয় সেই প্রেক্ষাপটে বিপর্যস্ত বিএনপিকে টিকিয়ে রাখতে বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেছিলেন । রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত তিনি একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন । দলের সাধারণ সদস্যপদও তাঁর ছিল না । গৃহবধূ থেকে পরবর্তী সময়ে আপোসহীন নেত্রী ও তারপরে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন তিনি । ১৯৯১–৯৬ এবং ২০০১–২০০৬ এই দুই মেয়াদে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর ধীরে ধীরে তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক পরিপূর্ণতা আসে । তাঁর গৃহীত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতি দিয়েছে । তিনি বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যে থেকে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন । তাঁর সময়েই  পোশাক তৈরি ও রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির বিস্তার লাভ ঘটে ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখে । শিক্ষা ও গবেষণামূলক কার্যক্রমের প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে । বিশ্বরাজনীতিমহলেও তিনি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।  আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাফল্য আসে । বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের পররাষ্ট্রনীতির প্রভাব ফেলেছিল তাঁর সরকার অর্থনীতিতে উদারীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করায়,  যার ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন সুযোগ উন্মোচিত হয়েছিল । প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল । ভারতের সাথে সাম্যতা রেখে সবার সাথে কানেক্টিভিটি বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল । যদিও ভারতের সাথে বিএনপি সরকারের কতটা সুসম্পর্ক ছিল তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে । কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চলতে থাকা দীর্ঘকালীন সংকট তিন বিঘা করিডোর পালাক্রমে ৬ ঘন্টা করে দুই দেশের জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল তাঁর আমলেই ১৯৯২ সালের জুন মাসে । তবে তার সময়ে সুশাসনে ঘাটতিও ছিল প্রচুর । তিনি সবসময় একদল স্তাবক পরিবৃত থাকতেন

তাঁর বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার উত্থান-পতন, মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব, মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার, কারাবাস, নির্যাতন, প্রতিপক্ষের আক্রমণ, বিদ্বেষ, লাঞ্ছনা, জুলুম, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন তিনি । স্বামী ও কনিষ্ঠপুত্র আরাফাত রহমানকে হারানোর গভীর শোকজনিত ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ও দীর্ঘ শারীরিক জটিলতা ও রোগযন্ত্রণা বয়ে বয়ে তাঁর জীবনের যবনিক নেমে আসে । 

বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়ানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে । বর্তমান বাংলাদেশের অস্থির ও অনিশ্চিত সময়ে তাঁর চিরপ্রস্থান সেদেশের সংকটকে আরো ঘনীভূত করবে ।

No comments:

Post a Comment