Wednesday, October 22, 2025

ঊনবিংশ শতকের যুবসমাজ ও দেবী কালিকা

🌺 ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব

ভূমিকা–

ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল বাংলার সমাজজীবনের এক নবজাগরণের যুগ। সমাজে একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে জন্ম নিল এক নতুন চিন্তাধারা, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ। অন্যদিকে তেমনি সমাজের অন্তরাত্তায় জেগে উঠেছিল জাতীয়তাবোধ ধর্ম চেতনা ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান । এই আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে বাঙালির এক মহান প্রতীক রূপে উদ্ভাসিত হন মা কালিকা । এই সময়ের যুবকরা পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী চিন্তার মুখোমুখি হয়ে নিজেদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ইংরেজ শাসনের ফলে দমিত জাতির চেতনায় মা কালী হয়ে ওঠেন প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রতীক । কালীর রুদ্র ভয়ংকর অথচ মাতৃত্বময় রূপ যুবকদের মনে জাগিয়ে তোলে এক অন্তর্গত শক্তি তারা অনুভব করেন মা কালী ধ্বংস করেন কেবল অশুভকে অন্যায়কে । তিনি যেন তাঁদেরও সাহস যোগান অন্যায় ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ।সংহার ও সৃষ্টির মিলিত শক্তির দেবী । কিন্তু এই নববোধের ভেতরেই এক গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল— আধুনিকতার আকর্ষণ ও ঐতিহ্যের টান। উনবিংশ শতাব্দীতে মা কালীর পূজা বাঙালি যুব সমাজের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করে মূলত বিভিন্ন জমিদার ও ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর প্রচলন শুরু হয় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও রামপ্রসাদের মত ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে এই পূজা আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই সময়ের যুবকেরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তির সাথে উপাসনা করে ।
এই যুগের যুবসমাজ, যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছিল, তারা নিজের জাতীয় ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক খুঁজতে গিয়ে ফিরে তাকায় মা কালিকা-র দিকে।
তিনি তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন আত্মশক্তির মূর্তি, জাতীয় গৌরবের প্রতীক ও নবজাগরণের মাতৃরূপ।

নবজাগরণ ও যুবসমাজের মানসিক পরিবর্তন

ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজে নানা সামাজিক কুসংস্কার জাতপাত অন্ধবিশ্বাস ও নারী নির্যাতন চলছিল । শুরুতে বাংলা সমাজে একদিকে রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে যুক্তিবাদী চিন্তার উত্থান, অন্যদিকে সমাজে গভীর কুসংস্কার, জাতিভেদ ও অন্ধবিশ্বাসের প্রভাব ছিল প্রবল।
এই বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল সেই সময়ের যুবসমাজ।
তারা একদিকে যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত, অন্যদিকে নিজের শিকড়ের সন্ধানে ব্যাকুল। এই প্রেক্ষাপটে মা কালীর অনুমুক্ত নির্ভীক ও রক্তমাখা রূপ সমাজের চোখে হয়ে ওঠে সংস্কার ভাঙ্গা শক্তির প্রতীক রূপ । যেমন স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'আমাদের চাই না ভীরু ভক্তি চাই কালীর মতো শক্তি ও সাহস ।' এই আহ্বান যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আত্মবিশ্বাসে ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে ।
এই সন্ধানেই তারা আবিষ্কার করে মা কালিকা-র রূপে নিজের ঐতিহ্য, শক্তি ও আত্মমর্যাদার প্রতীককে।

 মা কালিকা : শক্তি ও জাগরণের দেবী–

মা কালিকা শাক্তধর্মে শক্তির চূড়ান্ত রূপ।
তিনি একাধারে ভয়ংকর ও করুণাময়ী, বিনাশিনী ও জননী।
তাঁর রূপের মধ্যে নিহিত আছে সৃষ্টি ও ধ্বংসের এক অদ্বিতীয় দ্বন্দ্ব—
যা জীবনদর্শনকেই প্রতিফলিত করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে মা কালী হয়ে ওঠেন বিপ্লবীদের আদর্শ দেবী । শোনা যায় অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, এমনকি ছোটো ছোটো যুবগোষ্ঠীর অনেক যুবক গোপনে কালীপূজার আসরে অস্ত্র প্রতিজ্ঞা নিতেন দেশের স্বাধীনতার জন্য । ধুপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, ঢাকের শব্দে মিশে যেত শপথের ধ্বনি । সেই পবিত্র অন্ধকারে জেগে উঠত আগুন । যা পরে জ্বালিয়ে দিত সাম্রাজ্যের শেকল । তাঁদের কাছে কালী মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ন্যায় শক্তি । এই সময় যুবকরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তি ও ভালবাসার সাথে পূজা করতেন যা তাদের আধ্যাত্মিক চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল । যুবকরা নিজেদের মুক্তি সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনায় কালীর কাছে প্রার্থনা করতেন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিতা, গান ও নাটকে কালীর প্রতীকী উপস্থিতি সমাজ চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল । বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম সংগীতেও মাতৃভূমি কল্পিত হয়েছে দেবী মূর্তি রূপে । পরবর্তীকালে এই ভাবনা বিকশিত হয়ে কালীমূর্তিতে জাতীয় মাতার রূপ ধারণ করে । কালী সাধক কবিরাজ রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্তের গানে কালী শুধু ভক্তির দেবী নন । তিনি এক দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্র । তাঁদের গানের যেমন আছে ভক্তির আবেগ তেমনি আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।কালী পূজা বাঙালি যুব সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল । যার ফলস্বরূপ অনেক সাহিত্য ও সংগীত তৈরি হয়েছিল সে সময়ে ।

রামপ্রসাদ সেন তাঁর গানে লিখেছিলেন– 
> “কালো তোমার রূপ রে কালী, তাতে যে আলো ঝরে।”

এই ‘কালো’ রূপের মধ্যে যে আলো, সেই আলোই ঊনবিংশ শতাব্দীর তরুণদের চিন্তায় আনল আত্মপ্রত্যয়ের জ্যোতি।
তারা বুঝল, কালী মানে কেবল অন্ধকার নয়—অন্ধকার ভেদ করা আলোর শক্তি। এই সময়ের সাহিত্য ও সমাজে নারীর প্রতিচ্ছবি নতুন করে দেখা হচ্ছিল । মা কালীর চিত্র, যিনি একাধারে ভয়ংকরী ও মমতাময়ী, যুবসমাজকে শেখান নারীর শক্তিকে শ্রদ্ধা করতে । তাকে দেবীরূপে নয় । শক্তির প্রেরণার উৎস রূপে দেখতে । এর মধ্য দিয়ে সমাজে নারী পুরুষের সমতার ভাবনা জন্ম নেয় । এই ভাবনাই পড়ে নারী মুক্তি আন্দোলনের দর্শনকে প্রভাবিত করে ।

স্বামী বিবেকানন্দের কালীভাবনা ও যুবচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব সবচেয়ে গভীরভাবে দেখা যায় স্বামী বিবেকানন্দ-এর দর্শনে।
তাঁর কাছে কালী ছিলেন ভয়ের নয়, বরং শক্তির দেবী।
তিনি বলেছিলেন—

> “যে কালীকে তুমি ভয় পাও, সেই কালীই শক্তির মূর্তি। তাঁর পূজা মানে নিজের মধ্যে সেই শক্তির জাগরণ।”

বিবেকানন্দের আহ্বান ছিল স্পষ্ট—

 যুবকরা যেন নিজেদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তিকে চিনতে শেখে, নিজের জাতি ও সমাজের মুক্তির জন্য সেই শক্তিকে কাজে লাগায়।
এই ভাবনা যুবসমাজকে দার্শনিক শক্তির পাশাপাশি কর্মের অনুপ্রেরণাও দিয়েছিল।

 বঙ্কিমচন্দ্র ও দেশমাতার কালীরূপ–

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর চিন্তায় মা কালিকা এক নতুন অর্থে উদ্ভাসিত হন।
তাঁর “বন্দে মাতরম্‌” কবিতায় মাতৃভূমিকে কালীস্বরূপ কল্পনা করা হয়েছে—
তিনি অন্নদা, করুণাময়ী, কিন্তু প্রয়োজনে ভয়ংকর রণদুর্গা।
এভাবেই কালী দেবী হয়ে উঠলেন দেশমাতার প্রতীক।

এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবাদে ও আত্মবিসর্জনের চেতনায়।
মা কালিকা এখানে ধর্মীয় সত্তা নয়, বরং এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি।

 অরবিন্দ ঘোষ ও বিপ্লবী চেতনা–

শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ-এর চিন্তায় কালী রূপান্তরিত হন বিপ্লবের দেবী হিসেবে।
তিনি লিখেছিলেন—

> “যখন জাতি নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তখন কালী আসেন ধ্বংস করতে, যাতে নতুন সৃষ্টি সম্ভব হয়।”

এই ভাবনাই পরবর্তী বিপ্লবী আন্দোলনের যুবকদের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
তারা কালীকে দেখেছিল অন্যায় ও দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে।

কালীপূজা : সমাজসংহতি ও আত্মচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কালীপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল সামাজিক সংহতির প্রতীক।
শিক্ষিত যুবকরা নিজের পাড়ায়, সমাজে একত্রিত হয়ে কালীপূজার আয়োজন করত।
এই মিলনই জাতিগত ঐক্যের এক প্রতীক হয়ে ওঠে।
কালীপূজার আধ্যাত্মিকতা থেকে জন্ম নেয় সমষ্টিগত আত্মশক্তির ধারণা।

                       নারীশক্তি ও কালীভাবনা–

মা কালিকা নারী হয়েও সর্বশক্তিময়—এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায় নারীর মর্যাদা নিয়ে।
এই সময়েই নারীশিক্ষা ও নারীসমতার আন্দোলন শুরু হয়, যার পেছনে ছিল শক্তিস্বরূপা কালীচেতনার প্রভাব।
নারী আর দুর্বল নয়—তিনি সৃষ্টি, করুণা ও সাহসের প্রতীক।

মানসিক ও নৈতিক প্রভাব–

যুবসমাজ মা কালিকার ভক্তি থেকে শুধু ধর্মীয় আশ্রয় নয়, পেয়েছিল মানসিক দৃঢ়তাও।
কালী তাঁদের শিখিয়েছিলেন—
ভয় নয়, আত্মবিশ্বাসই জীবনের মূলমন্ত্র।
অতএব, কালীভক্তি হয়ে উঠেছিল তাদের কাছে এক নৈতিক পুনর্জাগরণের পথ।

উপসংহার–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল বহুমাত্রিক—
আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক।
তিনি ছিলেন একাধারে ভক্তির দেবী ও কর্মের অনুপ্রেরণা, জাতীয়তাবাদের মাতা ও ব্যক্তিসত্তার শক্তি।

বিবেকানন্দের ভাষায়—

> “শক্তি যদি জাগে, তবেই জাতি বাঁচে।”

মা কালিকার উপাসনার মধ্য দিয়েই এই যুগের যুবসমাজ সেই শক্তি খুঁজে পেয়েছিল—
যা তাদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল, জাতীয় চেতনা জ্বালিয়েছিল,
এবং বাঙালির নবজাগরণের ভিত রচনা করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর যুব সমাজের কাছে মা কালী ছিলেন শুধু উপাস্য দেবী নন, বরং চেতনার প্রতীক, শক্তির উৎস ও বিপ্লবের প্রেরণা । তাঁর রুদ্ররূপে সেসময়ের যুবক দেখেছিলেন সংস্কার ভাঙা ও প্রতিবাদের শক্তি । তাঁর মাতৃরূপে পেয়েছিলেন সান্তনা ও মমতা ।

 সংক্ষেপে বলা যায়,
ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল
আত্মশক্তির জাগরণ, দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা, এবং নবজাগরণের আত্মা। মা কালী হয়ে উঠেছিলেন এক যুগের মানসিক মুক্তির প্রতীক যা পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের পথ প্রশস্ত করে ।

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কালীপূজা

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কালীপূজা 

   ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অগ্নিযুগ শব্দটি এসেছে সেই সময়ের বিপ্লবী যুবকদের আত্মোৎসর্গ ও অনলস দেশপ্রেমের জন্য । এটি মূলত ১৯০৫ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত সময়কে নির্দেশ করে । যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর বাংলার যুবসমাজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় । এই বিপ্লবীদের মানসিক জগতের গভীরে যে শক্তি কাজ করেছিল তার অন্যতম উৎস ছিল মা কালিকা । সংহার, শক্তি ও মুক্তির চিরন্তন প্রতীক । তিনি রুদ্ররূপে ধ্বংস করেন অন্যায় । আবার মাতৃত্বের রক্ষা করেন সৃষ্টিকে । বিপ্লবীরা এই রূপেই দেখেছিলেন তাঁদের আদর্শ দেবীকে । যিনি অন্যায়ের বিনাশে অনুমোদন দেন, দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করার সাহস যোগান । তাঁরা বিশ্বাস করতেন যেমন কালী অসুর বধ করেন তেমনি পরাধীনতার অশুভ শক্তিকেও বিনাশ করতে প্রেরণা দেন ।

শোনা যায়, অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, এমনকি ছোটো ছোটো যুব বিপ্লবীগোষ্ঠী কালীপূজার রাতেই গোপনে অস্ত্র স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করতেন । মেদিনীপুর শহরের কর্নেলগোলা কালীমন্দিরেই দীক্ষা নিয়েছিলেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু। ধুপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, ঢাকের শব্দে মিশে যেত শপথের ধ্বনি । সেই পবিত্র অন্ধকারে জেগে উঠত আগুন । যা পরে জ্বালিয়ে দিত সাম্রাজ্যের শেকল ।

আজও যখন অন্যায় দেখি, নিপীড়ন দেখি, দুর্নীতি দেখি, তখন মনে হয় আমাদের দরকার সেই আগুন, সেই সাহস যা একদিন অগ্নিযুগের যুবকদের জাগিয়েছিল মা কালিকার আহ্বানে।

 হে চেতনার যোদ্ধাগণ, চলুন আমরা আজও সেই মন্ত্র জাগি–

এলো আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো, 
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে ।।

প্রাচীন ত্রিপুরার প্রাচীন কালীমন্দির

প্রাচীন ত্রিপুরার প্রাচীন কালীমন্দির 

ত্রিপুরার উদয়পুরে অবস্থিত মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির একটি প্রাচীন কালীমন্দির । ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা ধন্য মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । তবে ত্রিপুরারাজ্যে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার আরো প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে । আমরা জানি যে, প্রাচীনকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । সেই হিসেবে কুমিল্লা ও একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল । কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের চূড়ায় চন্ডীমন্দির বা চন্ডীমুড়া মন্দির নামে একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে । চন্ডীমুড়ায় দুটি মন্দির পাশাপাশি অবস্থিত । দক্ষিণ পাশের মন্দিরটি চন্ডী মন্দির ও উত্তর পাশের মন্দিরটি শিব মন্দির । চন্ডী মন্দিরটি দেবী কালিকার উদ্দেশ্যে নিবেদিত । এই চন্ডীমন্দির সম্বন্ধে একটি পুরাণ কাহিনি প্রচলিত রয়েছে । দেবী চন্ডী যখন শুম্ভ নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের সাথে যুদ্ধ করছিলেন তখন বেশ কিছু অসুর জঙ্গলে ঘেরা এই জায়গায় পালিয়ে আসে । দেবী তখন এখানে অসুরদের বধ করেন । দেবীর দেহতাপের ফলে পাহাড়ের মাটির রং লাল হয় । ফলে এই পাহাড়ের নাম লালমাই পাহাড় হয় ।

সপ্তম শতাব্দীর খড়্গবংশীয় মহারাজ দেবখড়্গ তাঁর রানি প্রভাবতীর ইচ্ছাতে এই মন্দির ও একটি শিব মন্দির নির্মাণ করেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ ও তার রানি হিন্দু ছিলেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ হয়েও মা চন্ডীর উপাসনা করতেন । বৌদ্ধরাজ দেবখড়্গের স্ত্রী প্রভাবতী দেবী অমর কীর্তি স্থাপনে বদ্ধপরিকর হয়ে এখানে দুটি মন্দির স্থাপন করেন । একটি চন্ডীমন্দির ও অপরটি শিব মন্দির চন্ডীমন্দিরে অষ্টভুজা সর্বানী মহাসরস্বতী । অপরটিতে শিবমূর্তি স্থাপন করেন । এরপর সময়ের সাথে মন্দির দুটি হারিয়ে যায় । ত্রিপুরার যুবরাজ চম্পক রায় দেওয়ানের ভগ্নী দ্বিতীয়া দেবী এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন । তিনি পাহাড়ের দক্ষিণ পূর্বে একটি দিঘি খনন করেন । যার নাম দুতিয়ার দিঘি ।

জয় মা । সবাইকে দীপাবলির শুভেচ্ছা ।

গাড়ুই ব্রত

 গাড়ুই ব্রত

           গাড়ুই ব্রত লৌকিক ব্রত । এর প্রতি পরতে পরতে লোকজীবনের ছাপ রয়েছে ।ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ধানের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় নব্য প্রস্তর যুগে ( ৭০০০-৬০০০ খ্রি.পূ. ) ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে । এরপর সিন্ধু সভ্যতায় (৩০০০-২৫০০ খ্রি. পূ.) ধান চাষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন । এটি একটি গ্রীষ্মকালীন ফসল হিসেবে চাষ করা হত । প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্র সমূহের উপর সর্বশেষ গবেষণায় জানা গেছে যে, সিন্ধুসভ্যতায় ধারণার চেয়েও আগে থেকেই ধান চাষ হত । গবেষণা আরও জানাচ্ছে যে, সিন্ধুসভ্যতার মানুষেরা মিশ্রকৃষির ক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য ছিল । তারা গ্রীষ্মকালে ধান, মিলিট ও শিম্ব জাতীয় শস্য উৎপাদন করত এবং শীতকালে গম, বার্লি ও ডাল জাতীয় শস্য উৎপাদন করত ।

প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থসমূহে ধানকে 'ব্রীহি' বলা হত । ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদসহ বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থে এটিকে একটি প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । বৈদিক যুগে ধানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য বিবেচনা করা হত এবং ব্যাপকভাবে চাষ করা হত । বৈদিক ধর্মীয় ভাবাপন্ন হওয়ার আগে কৌম মানুষেরা লৌকিক দেবদেবীর পূজার্চনা করত । সেখানে বৈদিক ব্রাহ্মণের প্রবেশ ঘটেনি । পরবর্তীসময়ে এইসব ব্রাত্য দেবদেবীরা দেবদেবীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন । বাংলার লোকধর্মীয় পূজাপদ্ধতিতে নৈবেদ্য বা পূজার উপকরণ হিসাবে গৃহস্থের উৎপাদিত ফসলের অংশ বা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সহজলভ্য উপকরণগুলোকেই নিবেদন করতে দেখা যায় । এরকম পূজায় বা আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত অনেক বিষয়ের মধ্যেই আমাদের অতিক্রম করে আসা প্রাচীন সভ্যতার কিছু কিছু বিষয় অজান্তেই থেকে যায় । এরকম শিলনোড়ার ব্যবহার প্রস্তরযুগের নিদর্শন, পূজার সামগ্রী কোশাকুশি তাম্রযুগের স্মৃতিবাহক । গাড়ুই ব্রতে জুমের চালের ব্যবহার বাঙালির কৌমজীবনের অধ্যায়ের ক্ষীণ নিদর্শন । বাঙালি যতই জাতের বড়াই করুক । আদিতে তারা কৌম ও সংকর জাতি । বিবর্তনের সেই অধ্যায়টা অজানা বলে আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে মরি । পূজার উপকরণ আমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় যাতে আমরা বুঝি ।

Tuesday, October 7, 2025

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয় 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

গত পরশুদিন আমরা গেছি ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চিক্কাবাল্লাপুর পাহাড়ে ঈশা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত আদিযোগী শিবমূর্তি দেখার জন্যে । বিশাল পাহাড়কে পেছনে রেখে দিগন্ত খোলা আকাশ এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝখানে বিশাল ধ্যানমগ্ন শিবমূর্তি । সমস্ত চরাচর জুড়ে এক নীরব নিস্তব্ধ প্রসন্নতা বিরাজ করে এখানে । প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় আদিযোগী মূর্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় আলো ও শব্দের যুগলবন্দী মোহময় ধারাভাষ্য । সঙ্গে সদগুরুর প্রবচন । প্রায় ১৫ মিনিটের এই অনুষ্ঠান অন্ধকার প্রান্তরে মৌনতার মাঝখানে যেন দৈববাণী ও আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে এক অনৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে । মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে যোগেশ্বর শিবের মিথসমূহ একে একে উন্মোচিত হয় আলো ও শব্দের মোহজালে তখন সমগ্র চত্বরে মহাবিশ্বের ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ জড়িয়ে ধরে যেন সমস্ত সত্তাকে । মৌনী যোগেন্দ্রর সঙ্গে একাত্মবোধ জেগে ওঠে । ভারতের নানাপ্রদেশের মানুষের ছায়ামিশ্রণের এক প্রান্তর । এখানে হিংসাবিদ্বেষ নেই । পরিচয়হীন আত্মপরিচয়ে এক । 'আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়' ।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ফেরার পথে ছেলে ও বৌমা আমাদের নিয়ে এল সেই চত্বরের বাইরে একটা বড়ো খাবারের দোকানে । কি সুন্দর দৃষ্টিনন্দন রেস্টুরেন্ট। পাহাড়ের ঢাল কেটে ধাপে ধাপে গ্রাহকদের বসার জায়গা করা হয়েছে অনেকটা গ্যালারির মতো । আলো ঝলমল ও খোলামেলা, গাছগাছালিতে ভরপুর ।  পাহাড়ের উপরের অংশটা নিয়ে দোতলা । সেখানেও পরিপাটি বসে খাওয়ার ব্যবস্থা । এককথায় পাহাড়ের ঢালটাকে কি সুন্দরভাবে কাজে লাগানো হয়েছে । আমরা হলে টিলা কেটে সমান করতাম । এখানকার মানুষ প্রকৃতিচেতনায় সমৃদ্ধ । সারা ব্যাঙ্গালোরে এতো বিশাল বিশাল ইটকাঠের ইমারত টাওয়ার থাকলেও বন কিন্তু চোখে পড়ার মতো । একটু পরপরই গাছগাছালিতে ঘেরা পার্ক রয়েছে । সর্বক্ষণ একটা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।  রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরপরই এখানে কর্মরত কয়েকটি ছেলেকে দেখে আমার রক্তের ভেতর একটা দোলা দিয়ে গেল । ছেলেগুলো আমাদের খাবার পরিবেশন করল । বাসনপত্র নিয়ে গেল ধোয়ার জন্যে । সবাই মিলে কাজ করছে এখানে । 

একটা ছেলে একটু দূরে বসে কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল আনমনে । আমি আমার খাওয়া সেরে তার পাশে বসলাম । পরিবারের সবাই আমাকে লক্ষ করছে । আমি ছেলেটার কাছে গিয়ে বললাম, ভাই, তূমহারা ঘর কাঁহা ? ও বলল, ত্রিপুরা। নুং বরক দে ? আমি প্রশ্ন করলাম । সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বড়ো বড়ো করে জবাব দিল,  ইঁ , নুং ? আমাকে প্রশ্ন করল । আং ব ত্রিপুরা হা নি । আমি বললাম । প্রশ্ন করলাম নিনি নক বিয়াং । বলল, মনুঘাট । আমবাসানি কান্দার' । আং সাব্রুমনি সে ।  আমিও আমার স্থাননাম বললাম । আমার আধভাঙা ককবরক শুনে মনে হল সে খুশি । দেববর্মা দে নুং । ইঁহি । ত্রিপুরা। তাম' নিনি মুং । চিকনিয়া ত্রিপুরা । ও বলল । 

চিকনিয়া জানাল কয়েকমাস যাবত এখানে কাজ করছে । বেতন মাসে সতেরো হাজার টাকা । দুবেলা খাবার ও থাকার জায়গা মালিকের দেওয়া । সে নাকি সাব্রুমেও ছিল কিছুদিন । মাগরুমে একটি ব্রিজ  তৈরির কাজ করেছিল কিছুদিন । আমি বললাম, তোমাদের দেখেই আমি আমার পরিবারকে বলেছি এরা ত্রিপুরার হবে । ছেলেটি হাসল । সারল্যের হাসি । আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগছে । ঘরের মানুষের সঙ্গে যেমন কথা বলছি । আপনি বাঙালি আমি ত্রিপুরা কিছু মনে হচ্ছে না । সুন্দর বাংলা বলে ছেলেটা । আমাকে পেয়ে আরও বলল, এখানে কাজ করছি ভালোই। কিন্তু ওরা কানাড়ায় কথা বলে । আমরা না বুঝলে গালাগাল দেয় । এছাড়া আর সবই ভালো । আমি বললাম, চলো একটা ছবি নিই দুজনে । সঙ্গে সঙ্গে ও খুশি । আমার পাশে এসে বসল । সেলফি তুললাম । তারপরেই তার ডাক পড়ল । সে উঠে চলে গেল কাজে । 

আমি মহেশ্বর শিবের মতো স্থানু হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম । আমার রক্তের ভেতর যেন ইতিহাসের কোন অনাদিকালের নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় রক্তের মিশ্রণের এক ফল্গুর কল্লোল উঠছে । আমিও সেই । আদিযোগী ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৬ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৬ )

আজ বিজয়া দশমী । দেবী দুর্গার বিসর্জনের দিন । ভারতের অন্য সব প্রান্তে এই দিনটি দশেরা উৎসব হিসেবে শ্রদ্ধা ভক্তির সঙ্গে পালিত হয় । রামায়ণ মহাকাব্যে বর্ণিত রামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ বিজয়ের এই দিনটিকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয় হিসেবে পালিত হয় । কর্ণাটক রাজ্যের মহীশূরে চামুন্ডেশ্বরী মন্দির, কুর্গের মাদিকেরীসহ সর্বত্র এই দশেরা উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় । দশেরাকে কর্নাটকের আঞ্চলিক উৎসবও বলা হয় । নবরাত্রির দিন থেকে এই উৎসব শুরু হয় । আজ ব্যাঙ্গালোর জুড়েই দেখলাম দশেরার প্রস্তুতি । বাজারে প্রচুর ফুল ফল ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে । সবাই সাধ্যমত ফুল, ফল, ফুলের মালা, আমের পল্লব, কলার চারা নিয়ে যাচ্ছেন । সকাল থেকেই বাড়িঘর সাজানো হয়েছে ফুল ও ফুলের মালায় । সদর দরজার দুপাশে লাগানো হয়েছে কলার চারা । মাঝখানে আলপনা । প্রতিটি বাড়ির সামনে বড়ো বড়ো চালকুমড়ো ও নারকেল ফাটিয়ে রাখা হয়েছে । অনেকটা আমাদের দক্ষিণ ত্রিপুরায় চৈত্র সংক্রান্তির দিনের আমের কুশি কেটে সত্তুরওড়ানোর মতো । যানবাহনগুলোকে ফুলের মালায় সাজানো হয়েছে । এদিকে বাঙালিদের পুজো প্যান্ডেলে বিজয়া দশমীর বিদায়ের সুর । সর্বত্র একটা নীরবতা । আনন্দ ও বেদনার পাশাপাশি অবস্থান । কি অদ্ভুত রসায়ন ! জীবনটাও এমনই ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৫ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালি দুর্গাপুজো (৫ )

এবারে আমি পরপর দুটি এপিসোডে বর্তমানে যেখানে আছি অর্থাৎ আমার বড়ো ছেলের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এলাকার একটা বড়ো দুর্গাপূজোর বিষয়ে কিছু জানিয়ে এবং তারপরে এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির একটি বিষয় যার সঙ্গে আমাদের দুর্গোৎসবের কিঞ্চিত সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ করে ব্যাঙ্গালোরের পূজা পরিক্রমা শেষ করব ।

দুর্গাপুজোর থিমে অনেক সময় চলচ্চিত্র বা সিনেমার বিষয় উঠে এসেছে । বিশেষ করে কলকাতা ও আগরতলার বড়ো বড়ো বারোয়ারি পুজোকমিটিও থিম পুজোগুলিতে।

এরকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত:

1. সত্যজিৎ রায় স্মরণে থিম –

অনেক পুজো কমিটি “পথের পাঁচালী”, “অপু ট্রিলজি”, বা “গুপী গাইন বাঘা বাইন”–এর দৃশ্য দিয়ে থিম সাজিয়েছে।
বিশেষত ২০১৯-এ সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একাধিক পুজো তাঁকে কেন্দ্র করে থিম নিয়েছিল।
2. বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ –
কিছু পূজায় ৫০–৬০–৭০-এর দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টার, গান, সেট, দৃশ্য ব্যবহার করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে।
যেমন: উত্তম-সুচিত্রার জনপ্রিয় ছবি সাগরিকা, হারানো সুর, পিকনিক ইত্যাদির আবহ।
3. বলিউড ও বিশ্বসিনেমা থিম –
মাঝে মাঝে “শোলে”, “মুঘল-এ-আজম”, এমনকি “হ্যারি পটার” বা “অ্যাভেঞ্জার্স”-এর চরিত্র নিয়ে থিম তৈরি হয়েছে।
তবে এসব সাধারণত আকর্ষণ করার জন্য, আধ্যাত্মিকতার সাথে মেলানোর চেষ্টা করা হয়।
4. সামাজিক বার্তা মূলক সিনেমা –
“পথের পাঁচালী” বা “মেঘে ঢাকা তারা”-র মতো সিনেমার দারিদ্র্য, সংগ্রাম, সমাজ-বাস্তবতার দিক তুলে ধরা হয়েছে।
থিমের মাধ্যমে বলা হয়, দেবী শক্তি শুধু পুজো নয়, বাস্তব জীবনের সংগ্রামে পাশে থাকার প্রতীক।

তেমনি একটি চলচ্চিত্রের থিমকে নিয়ে পুজোর আয়োজন করেছেন ব্যাঙ্গালুরুর আরোহন সোসিও কালচারাল এসোসিয়েশন। কাঠগুড়ির পাশে বেলাথুরে তাঁদের পুজোমণ্ডপের এবারের থিম 'দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার' । থিমটি নেয়া হয়েছে 2019 সালের হিট বাংলা ছায়াছবি 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' এর বিষয়েকে নিয়ে । কাহিনি ইতিহাসের একটা ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে থ্রিলারধর্মী করে তোলা হয়েছে । কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর জগৎ শেঠের কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ উপঢৌকন পেয়েছিলেন । সেই সম্পদ যাতে ইংরেজের হাতে না পড়ে সেজন্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেগুলো দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার মন্দিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন । তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম সেই রহস্যময় সম্পদ খুঁজে পায়নি । ইতিহাসের অধ্যাপক সুবর্ণ সেন, ভাইপো আবির এবং তাঁর বন্ধু ঝিনুককে নিয়ে সেই রহস্য উন্মোচনের জন্য সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন । কাহিনির সেই দেবীদ্বারের আদলে তৈরি তাঁদের মন্ডপ । প্রতিমাও দৃষ্টিনন্দন । মন্ডপের ভেতরের সৌন্দর্যায়ন করেছেন সংগঠনেরই একঝাঁক শিল্পী । ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজো ও প্রতিদিন মধ্যাহ্নে সবার জন্যে প্রসাদের ব্যবস্থা করেছেন । বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল জমাটি । প্রতি সন্ধ্যায় বহিরাগত শিল্পীরা ও সংগঠনের সদস্যগণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন । অষ্টমীর রাতে বরিষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে এক অভিনব ফ্যাশন শোএর আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তারা । ব্যাঙ্গালোরে সব পুজো প্যান্ডেলে দেখলাম বয়স্ক নাগরিকদের বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হয় । পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শারীরিক অসুস্থতা, ডায়ালিসিসের কষ্ট সহ্য করেও অনেকে মঞ্চে ক্যাট ওয়াক করেছেন । এই ফ্যাশন শোএর বিষয় নেওয়া হয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাজপোষাক ।

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের কালে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা সাহিত্য ও শিল্পকলা, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । সেই পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আধুনিকতায় এগিয়েছিলেন । এই পরিবারের জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাঙালিদের আধুনিক কায়দায় শাড়ি পরাতে শিখিয়েছিলেন । ঠাকুরবাড়ির বউদের শাড়ি পরার ধরনই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাঙালি রমণীদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায় । পাশাপাশি এই পরিবারের সদস্য সদস্যারা অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছিলেন । ঠাকুর পরিবারের প্রথিতযশা পুরুষ ও রমণীদের চরিত্রাভিনয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এই ফ্যাশন শো । বিষয়টি অভিনব ও গবেষণালব্ধ । আধুনিক অঙ্গনে একটা সময়কে তুলে ধরা হয়েছে । এই সংগঠনের তরুণ সদস্যরাও কম যান কিসে ? তাঁরাও দল বেঁধে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বাঙালিবাবুটি সেজে মঞ্চে উঠেছিলেন এই সন্ধ্যায় । গত ত্রিশে সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজা পত্রিকার পাঁচের পাতায় আরোহন কালচারাল এসোসিয়েশনের প্রতিমার ছবি ছাপা হয়েছে যত্নের সঙ্গে ।