Wednesday, October 22, 2025

ঊনবিংশ শতকের যুবসমাজ ও দেবী কালিকা

🌺 ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব

ভূমিকা–

ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল বাংলার সমাজজীবনের এক নবজাগরণের যুগ। সমাজে একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে জন্ম নিল এক নতুন চিন্তাধারা, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ। অন্যদিকে তেমনি সমাজের অন্তরাত্তায় জেগে উঠেছিল জাতীয়তাবোধ ধর্ম চেতনা ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান । এই আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে বাঙালির এক মহান প্রতীক রূপে উদ্ভাসিত হন মা কালিকা । এই সময়ের যুবকরা পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী চিন্তার মুখোমুখি হয়ে নিজেদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ইংরেজ শাসনের ফলে দমিত জাতির চেতনায় মা কালী হয়ে ওঠেন প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রতীক । কালীর রুদ্র ভয়ংকর অথচ মাতৃত্বময় রূপ যুবকদের মনে জাগিয়ে তোলে এক অন্তর্গত শক্তি তারা অনুভব করেন মা কালী ধ্বংস করেন কেবল অশুভকে অন্যায়কে । তিনি যেন তাঁদেরও সাহস যোগান অন্যায় ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ।সংহার ও সৃষ্টির মিলিত শক্তির দেবী । কিন্তু এই নববোধের ভেতরেই এক গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল— আধুনিকতার আকর্ষণ ও ঐতিহ্যের টান। উনবিংশ শতাব্দীতে মা কালীর পূজা বাঙালি যুব সমাজের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করে মূলত বিভিন্ন জমিদার ও ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর প্রচলন শুরু হয় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও রামপ্রসাদের মত ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে এই পূজা আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই সময়ের যুবকেরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তির সাথে উপাসনা করে ।
এই যুগের যুবসমাজ, যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছিল, তারা নিজের জাতীয় ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক খুঁজতে গিয়ে ফিরে তাকায় মা কালিকা-র দিকে।
তিনি তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন আত্মশক্তির মূর্তি, জাতীয় গৌরবের প্রতীক ও নবজাগরণের মাতৃরূপ।

নবজাগরণ ও যুবসমাজের মানসিক পরিবর্তন

ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজে নানা সামাজিক কুসংস্কার জাতপাত অন্ধবিশ্বাস ও নারী নির্যাতন চলছিল । শুরুতে বাংলা সমাজে একদিকে রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে যুক্তিবাদী চিন্তার উত্থান, অন্যদিকে সমাজে গভীর কুসংস্কার, জাতিভেদ ও অন্ধবিশ্বাসের প্রভাব ছিল প্রবল।
এই বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল সেই সময়ের যুবসমাজ।
তারা একদিকে যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত, অন্যদিকে নিজের শিকড়ের সন্ধানে ব্যাকুল। এই প্রেক্ষাপটে মা কালীর অনুমুক্ত নির্ভীক ও রক্তমাখা রূপ সমাজের চোখে হয়ে ওঠে সংস্কার ভাঙ্গা শক্তির প্রতীক রূপ । যেমন স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'আমাদের চাই না ভীরু ভক্তি চাই কালীর মতো শক্তি ও সাহস ।' এই আহ্বান যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আত্মবিশ্বাসে ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে ।
এই সন্ধানেই তারা আবিষ্কার করে মা কালিকা-র রূপে নিজের ঐতিহ্য, শক্তি ও আত্মমর্যাদার প্রতীককে।

 মা কালিকা : শক্তি ও জাগরণের দেবী–

মা কালিকা শাক্তধর্মে শক্তির চূড়ান্ত রূপ।
তিনি একাধারে ভয়ংকর ও করুণাময়ী, বিনাশিনী ও জননী।
তাঁর রূপের মধ্যে নিহিত আছে সৃষ্টি ও ধ্বংসের এক অদ্বিতীয় দ্বন্দ্ব—
যা জীবনদর্শনকেই প্রতিফলিত করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে মা কালী হয়ে ওঠেন বিপ্লবীদের আদর্শ দেবী । শোনা যায় অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, এমনকি ছোটো ছোটো যুবগোষ্ঠীর অনেক যুবক গোপনে কালীপূজার আসরে অস্ত্র প্রতিজ্ঞা নিতেন দেশের স্বাধীনতার জন্য । ধুপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, ঢাকের শব্দে মিশে যেত শপথের ধ্বনি । সেই পবিত্র অন্ধকারে জেগে উঠত আগুন । যা পরে জ্বালিয়ে দিত সাম্রাজ্যের শেকল । তাঁদের কাছে কালী মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ন্যায় শক্তি । এই সময় যুবকরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তি ও ভালবাসার সাথে পূজা করতেন যা তাদের আধ্যাত্মিক চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল । যুবকরা নিজেদের মুক্তি সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনায় কালীর কাছে প্রার্থনা করতেন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিতা, গান ও নাটকে কালীর প্রতীকী উপস্থিতি সমাজ চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল । বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম সংগীতেও মাতৃভূমি কল্পিত হয়েছে দেবী মূর্তি রূপে । পরবর্তীকালে এই ভাবনা বিকশিত হয়ে কালীমূর্তিতে জাতীয় মাতার রূপ ধারণ করে । কালী সাধক কবিরাজ রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্তের গানে কালী শুধু ভক্তির দেবী নন । তিনি এক দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্র । তাঁদের গানের যেমন আছে ভক্তির আবেগ তেমনি আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।কালী পূজা বাঙালি যুব সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল । যার ফলস্বরূপ অনেক সাহিত্য ও সংগীত তৈরি হয়েছিল সে সময়ে ।

রামপ্রসাদ সেন তাঁর গানে লিখেছিলেন– 
> “কালো তোমার রূপ রে কালী, তাতে যে আলো ঝরে।”

এই ‘কালো’ রূপের মধ্যে যে আলো, সেই আলোই ঊনবিংশ শতাব্দীর তরুণদের চিন্তায় আনল আত্মপ্রত্যয়ের জ্যোতি।
তারা বুঝল, কালী মানে কেবল অন্ধকার নয়—অন্ধকার ভেদ করা আলোর শক্তি। এই সময়ের সাহিত্য ও সমাজে নারীর প্রতিচ্ছবি নতুন করে দেখা হচ্ছিল । মা কালীর চিত্র, যিনি একাধারে ভয়ংকরী ও মমতাময়ী, যুবসমাজকে শেখান নারীর শক্তিকে শ্রদ্ধা করতে । তাকে দেবীরূপে নয় । শক্তির প্রেরণার উৎস রূপে দেখতে । এর মধ্য দিয়ে সমাজে নারী পুরুষের সমতার ভাবনা জন্ম নেয় । এই ভাবনাই পড়ে নারী মুক্তি আন্দোলনের দর্শনকে প্রভাবিত করে ।

স্বামী বিবেকানন্দের কালীভাবনা ও যুবচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব সবচেয়ে গভীরভাবে দেখা যায় স্বামী বিবেকানন্দ-এর দর্শনে।
তাঁর কাছে কালী ছিলেন ভয়ের নয়, বরং শক্তির দেবী।
তিনি বলেছিলেন—

> “যে কালীকে তুমি ভয় পাও, সেই কালীই শক্তির মূর্তি। তাঁর পূজা মানে নিজের মধ্যে সেই শক্তির জাগরণ।”

বিবেকানন্দের আহ্বান ছিল স্পষ্ট—

 যুবকরা যেন নিজেদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তিকে চিনতে শেখে, নিজের জাতি ও সমাজের মুক্তির জন্য সেই শক্তিকে কাজে লাগায়।
এই ভাবনা যুবসমাজকে দার্শনিক শক্তির পাশাপাশি কর্মের অনুপ্রেরণাও দিয়েছিল।

 বঙ্কিমচন্দ্র ও দেশমাতার কালীরূপ–

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর চিন্তায় মা কালিকা এক নতুন অর্থে উদ্ভাসিত হন।
তাঁর “বন্দে মাতরম্‌” কবিতায় মাতৃভূমিকে কালীস্বরূপ কল্পনা করা হয়েছে—
তিনি অন্নদা, করুণাময়ী, কিন্তু প্রয়োজনে ভয়ংকর রণদুর্গা।
এভাবেই কালী দেবী হয়ে উঠলেন দেশমাতার প্রতীক।

এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবাদে ও আত্মবিসর্জনের চেতনায়।
মা কালিকা এখানে ধর্মীয় সত্তা নয়, বরং এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি।

 অরবিন্দ ঘোষ ও বিপ্লবী চেতনা–

শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ-এর চিন্তায় কালী রূপান্তরিত হন বিপ্লবের দেবী হিসেবে।
তিনি লিখেছিলেন—

> “যখন জাতি নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তখন কালী আসেন ধ্বংস করতে, যাতে নতুন সৃষ্টি সম্ভব হয়।”

এই ভাবনাই পরবর্তী বিপ্লবী আন্দোলনের যুবকদের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
তারা কালীকে দেখেছিল অন্যায় ও দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে।

কালীপূজা : সমাজসংহতি ও আত্মচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কালীপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল সামাজিক সংহতির প্রতীক।
শিক্ষিত যুবকরা নিজের পাড়ায়, সমাজে একত্রিত হয়ে কালীপূজার আয়োজন করত।
এই মিলনই জাতিগত ঐক্যের এক প্রতীক হয়ে ওঠে।
কালীপূজার আধ্যাত্মিকতা থেকে জন্ম নেয় সমষ্টিগত আত্মশক্তির ধারণা।

                       নারীশক্তি ও কালীভাবনা–

মা কালিকা নারী হয়েও সর্বশক্তিময়—এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায় নারীর মর্যাদা নিয়ে।
এই সময়েই নারীশিক্ষা ও নারীসমতার আন্দোলন শুরু হয়, যার পেছনে ছিল শক্তিস্বরূপা কালীচেতনার প্রভাব।
নারী আর দুর্বল নয়—তিনি সৃষ্টি, করুণা ও সাহসের প্রতীক।

মানসিক ও নৈতিক প্রভাব–

যুবসমাজ মা কালিকার ভক্তি থেকে শুধু ধর্মীয় আশ্রয় নয়, পেয়েছিল মানসিক দৃঢ়তাও।
কালী তাঁদের শিখিয়েছিলেন—
ভয় নয়, আত্মবিশ্বাসই জীবনের মূলমন্ত্র।
অতএব, কালীভক্তি হয়ে উঠেছিল তাদের কাছে এক নৈতিক পুনর্জাগরণের পথ।

উপসংহার–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল বহুমাত্রিক—
আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক।
তিনি ছিলেন একাধারে ভক্তির দেবী ও কর্মের অনুপ্রেরণা, জাতীয়তাবাদের মাতা ও ব্যক্তিসত্তার শক্তি।

বিবেকানন্দের ভাষায়—

> “শক্তি যদি জাগে, তবেই জাতি বাঁচে।”

মা কালিকার উপাসনার মধ্য দিয়েই এই যুগের যুবসমাজ সেই শক্তি খুঁজে পেয়েছিল—
যা তাদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল, জাতীয় চেতনা জ্বালিয়েছিল,
এবং বাঙালির নবজাগরণের ভিত রচনা করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর যুব সমাজের কাছে মা কালী ছিলেন শুধু উপাস্য দেবী নন, বরং চেতনার প্রতীক, শক্তির উৎস ও বিপ্লবের প্রেরণা । তাঁর রুদ্ররূপে সেসময়ের যুবক দেখেছিলেন সংস্কার ভাঙা ও প্রতিবাদের শক্তি । তাঁর মাতৃরূপে পেয়েছিলেন সান্তনা ও মমতা ।

 সংক্ষেপে বলা যায়,
ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল
আত্মশক্তির জাগরণ, দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা, এবং নবজাগরণের আত্মা। মা কালী হয়ে উঠেছিলেন এক যুগের মানসিক মুক্তির প্রতীক যা পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের পথ প্রশস্ত করে ।

No comments:

Post a Comment