Wednesday, January 17, 2024

লোকধর্ম ও লোকাচার

লোকধর্ম ও লোকাচার

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


পৃথিবীর যে কোন দেশেরই সৃষ্টিশীল কর্মপ্রণোদনায় সেই দেশের লোকসংস্কৃতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । মূলত, লোকসংস্কৃতি সৃষ্টিশীলতার আদি ও অকৃত্রিম উৎসমূল । আধুনিক বাংলাসাহিত্য বহিরঙ্গে যতই কৃত্রিম অলংকারের সজ্জিত হোক না কেন, তার অন্তর্মূলে লোকসংস্কৃতির প্রবহমান ধারাকে অস্বীকার করা যায় না ।  সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞে লোকসংস্কৃতি প্রণোদনা শেকড় অভিমুখী অভিযাত্রা । লোকসংস্কৃতির সূত্র ধরেই মানবগোষ্ঠীর সংস্কৃতিচেতনা ও আদিমননের উৎসে পৌঁছানো যায় । যাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে লোকসংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জড়িয়ে থাকার ফলে তার সূত্র ধরে একটা জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক বিবর্তনের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় ।

লোকসংস্কৃতির বহু শাখার মধ্যে অন্যতম লোকধর্ম ও লোকাচার । মানুষের দুর্বল মানসিকতা অনিশ্চয়তার আশঙ্কা শুভ ও শুভ বোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে লোকধর্মের । লোকসংস্কৃতির সঙ্গে লোকধর্মের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । লোকধর্মীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে লোকসংস্কৃতিক উপাদান নিহিত থাকে । লৌকিক ধর্মাচরণকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার জন্য লোকসংস্কৃতিক বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহার করা হয় । আবার লোকসংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালনের সময়ও ধর্মীয় বিষয় তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে । ফলে সাংস্কৃতিক আচরণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকধর্ম ও লোকসংস্কৃতি ও প্রত্যভাবে জড়িত হয়ে পড়ে এবং দুটি ক্ষেত্রে একটা সমন্বয়ধর্মীতা লক্ষ্য করা যায় ।

লোক ধর্মের প্রধান বিষয় হল ভক্তি বা শ্রদ্ধা । সংস্কৃতির এই পর্যায়ের বিভিন্ন বিভাগে– ১)  প্রকৃতির শক্তিকে ভক্তি প্রকাশ করা হয় ২) পূর্বপুরুষদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় ৩) শক্তিমান দেবতাদের ভক্তি করা হয় এবং ৪) অশুভ শক্তিতেও মান্য করতে দেখা যায় । এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে পূজা, উপাসনা কিংবা লৌকিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিলক্ষিত হয় । প্রচলিত উচ্চ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের বিপরীতে লোকধর্মের ধারাটি প্রবাহমান থাকে । লোকধর্মের মধ্যে যাদু বিশ্বাস, কুসংস্কার ও মিথের প্রভাব থাকে । লোকধর্মের বিষয়গুলো প্রচলিত ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না । কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক বিভিন্ন লৌকিক কাব্যগ্রন্থের বর্ণনায় লোকঐতিহ্য উঠে আসে । ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে লোকঐতিহ্যের অবদান বিশাল প্রভাব ফেলে । এর মধ্যে নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ ও নিহিত থাকে । লোকধর্ম অভিজাতধর্মের সঙ্গে অনেক সময় মেলেনা । কিন্তু অভিজাতধর্মের অনুশীলনে লোকধর্মের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাদান আচার বা প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয় । কাজেই অভিজাতধর্মের উৎস সন্ধান করতে গেলে লোকজ ধর্মকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় । লোকধর্মের মূল কথা একে অপরের সাথে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা। লোকজীবনের সুদৃঢ় বাঁধুনী লোকসংস্কৃতি ও লোক ধর্মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত । সুসংহত সমাজসৃষ্টিতে লোকধর্মের ভূমিকা ফল্গুধারার মতো বইতে থাকে ।

এই লোকধর্মকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় বিভিন্ন লোকাচার । লোক মানে মানুষ । আচার অর্থ প্রথা বা আচরণ । অতএব লোকাচার হল এক সংহত জনগোষ্ঠীর পালিত পদ্ধতি বা আচরণ । সমাজবদ্ধ মানুষ সমাজের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নানারকম পদ্ধতি বা আচরণ অনুসরণ করে । এই সমস্ত আচরণ বা পদ্ধতির নাম লোকাচার । সমাজবিজ্ঞানী  w. G. Sumner-এর মতে 'সামাজিক পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজের অজ্ঞাতে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ যেসব আচরণবিধিকে অনুসরণ করে সেই সব আচরণবিধি হচ্ছে লোকাচার ।  P Gisbert বলেন, 'স্বতঃস্ফূর্ত মানবীয় আচরণ হল লোকাচার ।'

লোকাচারের বিভিন্ন ধারা রয়েছে । ১) সামাজিক ঐতিহ্য সংক্রান্ত লোকাচার ২) পোশাক পরিচ্ছদ সংক্রান্ত লোকাচার ৩) কথোপকথন সংক্রান্ত লোকাচার ৪) আচরণ সংক্রান্ত লোকাচার ৪) শিষ্টাচার সংক্রান্ত লোকাচার ৫) ধর্ম ও উৎসব সংক্রান্ত লোকাচার ইত্যাদি ।

লোকাচারের বৈশিষ্ট্য :
১) লোকাচার সমাজ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ।
২) লোকাচারের পুনরাবৃত্তি ঘটে । বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারংবার অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজের লোকাচারের একটা মান্য রূপ পায় 
৩) লোকাচার স্বতঃস্ফূর্ত ও অপরিকল্পিতভাবেই সমাজে উদ্ভব হয় ।
 ৪) লোকাচারের আইনি বা নৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই । লোকাচার পরম্পরা সূত্রেই প্রয়োগ হয় । 
৫) জনসমাজ ভেদে লোকাচারের ও তারতম্য ঘটে ।
৬) বিশেষ বিশেষ লোকাচার বিশেষ বিশেষ জাতি গোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে ।

বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষকে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম লোকাচার পালন করতে দেখা যায় । কিছু কিছু লোকাচার সমাজে কঠোরভাবে মান্য করা হয় । সমাজ জীবনকে সুস্থ সুন্দর ও স্বাভাবিক রাখার জন্য সমাজবদ্ধ মানুষ এই লোকাচারগুলো পালন করে থাকে । সুসংহত জনগোষ্ঠীতে আবার কিছু কিছু বিশেষ আচার-আচরণকে পরিত্যাজ্য বলে মান্য করা হয় এবং জীবনচর্যায়ও তা অনুসরণ করা হয় । লোকাচারের অবশ্য পালনের দ্বারা অনুশাসনের মাধ্যমে সামাজিক অনুষ্ঠানসমূহের মধ্যে একপ্রকার শৃঙ্খলা ও সমন্বয় রক্ষা করতে দেখা যায় । সরল গ্রামজীবনে পালিত লোকাচার সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করা বা নিয়ন্ত্রণ করারও মাধ্যম । মূলত, সমাজ জীবনে লোকাচার সমূহ বংশ-পরম্পরাক্রমে পালিত হয়ে লোকধর্মের মতোই এক একটি জাতিগোষ্ঠীকে আন্তর্সম্পর্কে বেঁধে রাখে ।

No comments:

Post a Comment