Tuesday, October 7, 2025

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৫ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালি দুর্গাপুজো (৫ )

এবারে আমি পরপর দুটি এপিসোডে বর্তমানে যেখানে আছি অর্থাৎ আমার বড়ো ছেলের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এলাকার একটা বড়ো দুর্গাপূজোর বিষয়ে কিছু জানিয়ে এবং তারপরে এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির একটি বিষয় যার সঙ্গে আমাদের দুর্গোৎসবের কিঞ্চিত সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ করে ব্যাঙ্গালোরের পূজা পরিক্রমা শেষ করব ।

দুর্গাপুজোর থিমে অনেক সময় চলচ্চিত্র বা সিনেমার বিষয় উঠে এসেছে । বিশেষ করে কলকাতা ও আগরতলার বড়ো বড়ো বারোয়ারি পুজোকমিটিও থিম পুজোগুলিতে।

এরকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত:

1. সত্যজিৎ রায় স্মরণে থিম –

অনেক পুজো কমিটি “পথের পাঁচালী”, “অপু ট্রিলজি”, বা “গুপী গাইন বাঘা বাইন”–এর দৃশ্য দিয়ে থিম সাজিয়েছে।
বিশেষত ২০১৯-এ সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একাধিক পুজো তাঁকে কেন্দ্র করে থিম নিয়েছিল।
2. বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ –
কিছু পূজায় ৫০–৬০–৭০-এর দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টার, গান, সেট, দৃশ্য ব্যবহার করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে।
যেমন: উত্তম-সুচিত্রার জনপ্রিয় ছবি সাগরিকা, হারানো সুর, পিকনিক ইত্যাদির আবহ।
3. বলিউড ও বিশ্বসিনেমা থিম –
মাঝে মাঝে “শোলে”, “মুঘল-এ-আজম”, এমনকি “হ্যারি পটার” বা “অ্যাভেঞ্জার্স”-এর চরিত্র নিয়ে থিম তৈরি হয়েছে।
তবে এসব সাধারণত আকর্ষণ করার জন্য, আধ্যাত্মিকতার সাথে মেলানোর চেষ্টা করা হয়।
4. সামাজিক বার্তা মূলক সিনেমা –
“পথের পাঁচালী” বা “মেঘে ঢাকা তারা”-র মতো সিনেমার দারিদ্র্য, সংগ্রাম, সমাজ-বাস্তবতার দিক তুলে ধরা হয়েছে।
থিমের মাধ্যমে বলা হয়, দেবী শক্তি শুধু পুজো নয়, বাস্তব জীবনের সংগ্রামে পাশে থাকার প্রতীক।

তেমনি একটি চলচ্চিত্রের থিমকে নিয়ে পুজোর আয়োজন করেছেন ব্যাঙ্গালুরুর আরোহন সোসিও কালচারাল এসোসিয়েশন। কাঠগুড়ির পাশে বেলাথুরে তাঁদের পুজোমণ্ডপের এবারের থিম 'দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার' । থিমটি নেয়া হয়েছে 2019 সালের হিট বাংলা ছায়াছবি 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' এর বিষয়েকে নিয়ে । কাহিনি ইতিহাসের একটা ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে থ্রিলারধর্মী করে তোলা হয়েছে । কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর জগৎ শেঠের কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ উপঢৌকন পেয়েছিলেন । সেই সম্পদ যাতে ইংরেজের হাতে না পড়ে সেজন্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেগুলো দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার মন্দিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন । তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম সেই রহস্যময় সম্পদ খুঁজে পায়নি । ইতিহাসের অধ্যাপক সুবর্ণ সেন, ভাইপো আবির এবং তাঁর বন্ধু ঝিনুককে নিয়ে সেই রহস্য উন্মোচনের জন্য সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন । কাহিনির সেই দেবীদ্বারের আদলে তৈরি তাঁদের মন্ডপ । প্রতিমাও দৃষ্টিনন্দন । মন্ডপের ভেতরের সৌন্দর্যায়ন করেছেন সংগঠনেরই একঝাঁক শিল্পী । ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজো ও প্রতিদিন মধ্যাহ্নে সবার জন্যে প্রসাদের ব্যবস্থা করেছেন । বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল জমাটি । প্রতি সন্ধ্যায় বহিরাগত শিল্পীরা ও সংগঠনের সদস্যগণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন । অষ্টমীর রাতে বরিষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে এক অভিনব ফ্যাশন শোএর আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তারা । ব্যাঙ্গালোরে সব পুজো প্যান্ডেলে দেখলাম বয়স্ক নাগরিকদের বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হয় । পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শারীরিক অসুস্থতা, ডায়ালিসিসের কষ্ট সহ্য করেও অনেকে মঞ্চে ক্যাট ওয়াক করেছেন । এই ফ্যাশন শোএর বিষয় নেওয়া হয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাজপোষাক ।

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের কালে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা সাহিত্য ও শিল্পকলা, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । সেই পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আধুনিকতায় এগিয়েছিলেন । এই পরিবারের জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাঙালিদের আধুনিক কায়দায় শাড়ি পরাতে শিখিয়েছিলেন । ঠাকুরবাড়ির বউদের শাড়ি পরার ধরনই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাঙালি রমণীদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায় । পাশাপাশি এই পরিবারের সদস্য সদস্যারা অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছিলেন । ঠাকুর পরিবারের প্রথিতযশা পুরুষ ও রমণীদের চরিত্রাভিনয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এই ফ্যাশন শো । বিষয়টি অভিনব ও গবেষণালব্ধ । আধুনিক অঙ্গনে একটা সময়কে তুলে ধরা হয়েছে । এই সংগঠনের তরুণ সদস্যরাও কম যান কিসে ? তাঁরাও দল বেঁধে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বাঙালিবাবুটি সেজে মঞ্চে উঠেছিলেন এই সন্ধ্যায় । গত ত্রিশে সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজা পত্রিকার পাঁচের পাতায় আরোহন কালচারাল এসোসিয়েশনের প্রতিমার ছবি ছাপা হয়েছে যত্নের সঙ্গে ।

No comments:

Post a Comment