Tuesday, October 7, 2025

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয় 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

গত পরশুদিন আমরা গেছি ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চিক্কাবাল্লাপুর পাহাড়ে ঈশা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত আদিযোগী শিবমূর্তি দেখার জন্যে । বিশাল পাহাড়কে পেছনে রেখে দিগন্ত খোলা আকাশ এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝখানে বিশাল ধ্যানমগ্ন শিবমূর্তি । সমস্ত চরাচর জুড়ে এক নীরব নিস্তব্ধ প্রসন্নতা বিরাজ করে এখানে । প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় আদিযোগী মূর্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় আলো ও শব্দের যুগলবন্দী মোহময় ধারাভাষ্য । সঙ্গে সদগুরুর প্রবচন । প্রায় ১৫ মিনিটের এই অনুষ্ঠান অন্ধকার প্রান্তরে মৌনতার মাঝখানে যেন দৈববাণী ও আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে এক অনৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে । মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে যোগেশ্বর শিবের মিথসমূহ একে একে উন্মোচিত হয় আলো ও শব্দের মোহজালে তখন সমগ্র চত্বরে মহাবিশ্বের ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ জড়িয়ে ধরে যেন সমস্ত সত্তাকে । মৌনী যোগেন্দ্রর সঙ্গে একাত্মবোধ জেগে ওঠে । ভারতের নানাপ্রদেশের মানুষের ছায়ামিশ্রণের এক প্রান্তর । এখানে হিংসাবিদ্বেষ নেই । পরিচয়হীন আত্মপরিচয়ে এক । 'আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়' ।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ফেরার পথে ছেলে ও বৌমা আমাদের নিয়ে এল সেই চত্বরের বাইরে একটা বড়ো খাবারের দোকানে । কি সুন্দর দৃষ্টিনন্দন রেস্টুরেন্ট। পাহাড়ের ঢাল কেটে ধাপে ধাপে গ্রাহকদের বসার জায়গা করা হয়েছে অনেকটা গ্যালারির মতো । আলো ঝলমল ও খোলামেলা, গাছগাছালিতে ভরপুর ।  পাহাড়ের উপরের অংশটা নিয়ে দোতলা । সেখানেও পরিপাটি বসে খাওয়ার ব্যবস্থা । এককথায় পাহাড়ের ঢালটাকে কি সুন্দরভাবে কাজে লাগানো হয়েছে । আমরা হলে টিলা কেটে সমান করতাম । এখানকার মানুষ প্রকৃতিচেতনায় সমৃদ্ধ । সারা ব্যাঙ্গালোরে এতো বিশাল বিশাল ইটকাঠের ইমারত টাওয়ার থাকলেও বন কিন্তু চোখে পড়ার মতো । একটু পরপরই গাছগাছালিতে ঘেরা পার্ক রয়েছে । সর্বক্ষণ একটা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।  রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরপরই এখানে কর্মরত কয়েকটি ছেলেকে দেখে আমার রক্তের ভেতর একটা দোলা দিয়ে গেল । ছেলেগুলো আমাদের খাবার পরিবেশন করল । বাসনপত্র নিয়ে গেল ধোয়ার জন্যে । সবাই মিলে কাজ করছে এখানে । 

একটা ছেলে একটু দূরে বসে কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল আনমনে । আমি আমার খাওয়া সেরে তার পাশে বসলাম । পরিবারের সবাই আমাকে লক্ষ করছে । আমি ছেলেটার কাছে গিয়ে বললাম, ভাই, তূমহারা ঘর কাঁহা ? ও বলল, ত্রিপুরা। নুং বরক দে ? আমি প্রশ্ন করলাম । সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বড়ো বড়ো করে জবাব দিল,  ইঁ , নুং ? আমাকে প্রশ্ন করল । আং ব ত্রিপুরা হা নি । আমি বললাম । প্রশ্ন করলাম নিনি নক বিয়াং । বলল, মনুঘাট । আমবাসানি কান্দার' । আং সাব্রুমনি সে ।  আমিও আমার স্থাননাম বললাম । আমার আধভাঙা ককবরক শুনে মনে হল সে খুশি । দেববর্মা দে নুং । ইঁহি । ত্রিপুরা। তাম' নিনি মুং । চিকনিয়া ত্রিপুরা । ও বলল । 

চিকনিয়া জানাল কয়েকমাস যাবত এখানে কাজ করছে । বেতন মাসে সতেরো হাজার টাকা । দুবেলা খাবার ও থাকার জায়গা মালিকের দেওয়া । সে নাকি সাব্রুমেও ছিল কিছুদিন । মাগরুমে একটি ব্রিজ  তৈরির কাজ করেছিল কিছুদিন । আমি বললাম, তোমাদের দেখেই আমি আমার পরিবারকে বলেছি এরা ত্রিপুরার হবে । ছেলেটি হাসল । সারল্যের হাসি । আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগছে । ঘরের মানুষের সঙ্গে যেমন কথা বলছি । আপনি বাঙালি আমি ত্রিপুরা কিছু মনে হচ্ছে না । সুন্দর বাংলা বলে ছেলেটা । আমাকে পেয়ে আরও বলল, এখানে কাজ করছি ভালোই। কিন্তু ওরা কানাড়ায় কথা বলে । আমরা না বুঝলে গালাগাল দেয় । এছাড়া আর সবই ভালো । আমি বললাম, চলো একটা ছবি নিই দুজনে । সঙ্গে সঙ্গে ও খুশি । আমার পাশে এসে বসল । সেলফি তুললাম । তারপরেই তার ডাক পড়ল । সে উঠে চলে গেল কাজে । 

আমি মহেশ্বর শিবের মতো স্থানু হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম । আমার রক্তের ভেতর যেন ইতিহাসের কোন অনাদিকালের নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় রক্তের মিশ্রণের এক ফল্গুর কল্লোল উঠছে । আমিও সেই । আদিযোগী ।

No comments:

Post a Comment