প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৩ )
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব । বাংলার প্রতিটি গ্রাম নগরে দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । সে ধারা আজও বহমান । আজ ভুবনায়নের যুগে বাঙালি মায়ের আঁচল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বময় । বাঙালি যেখানেই গেছেন তাঁদের সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে গেছেন। সমস্ত রকমের সামাজিক অনুষ্ঠানসহ পূজাপার্বণ ও পালন করে আসছেন অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে । সেইমতো আজ দুর্গোৎসব হচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে এবং বিদেশেও । দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যকে তাঁরা ফুটিয়ে তুলছেন নানাভাবে । যখন যেখানে থাকছেন সেখানকার সংস্কৃতিকেও ধারণ করছেন আবার তার সাথে নিজেদের সংস্কৃতিকে মিশিয়ে এক মোহনায় নিয়ে আসছেন সৃষ্টিশীলতায় ও নিষ্ঠায় ।
হুগলির গুপ্তিপাড়াতে ১৭৯০ সালে ১২ জন বন্ধু মিলে যে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন তাই 'বারো ইয়ারি' বা 'বারোয়ারি' পূজা নামে পরিচিত হয় । প্রথমদিকে দুর্গাপুজো করতেন রাজরাজড়ারা, ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ বা জমিদারগণ । সেখানে সবার প্রবেশাধিকার ছিল না । বারোয়ারি পুজো শুরু হওয়ার পর থেকে দুর্গাপুজো সর্বজনীন রূপ নেয় । সেই থেকে বাঙালি যেখানেই গেছেন সেখানেই তাঁরা সমবেতভাবে দুর্গোৎসব পালন করছেন । ।
ভারতের বড়ো বড়ো শহরের মধ্যে ব্যাঙ্গালুরু অন্যতম । এই শহরে বাস করেন বহু বাঙালি । পিতৃমাতাভূমি ছেড়ে এসে এই প্রজন্মের অনেকে এখানে স্থায়ী বসত গড়ে নিয়েছেন । অনেকে রুটিরুজির প্রশ্নে এখানে এসে থাকছেন । যেখানে বাঙালি রয়েছে সেখানেই রয়েছে বাঙালি সমিতি, সংগঠন । তাঁরা শরৎকালে দুর্গোৎসবে মেতে উঠেন । সংবৎসর অন্যান্য পুজো, অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । ঐতিহ্যের অনুসারী হন । সেই সঙ্গে বাঙালি খোঁজেন তাঁদের আত্মপরিচয়ের শেকড় । সেই শেকড়ে ভর করেই তাঁরা পা বাড়ান আরেক ভবিষ্যতের দিকে । সে কারণেই ব্যাঙ্গালুরুর রামমূর্তিনগরের শ্রীহট্ট সম্মিলনী এবছর তাঁদের পুজোর ভাবনা রেখেছেন 'অস্তিত্ব' । তাঁরা দেবীপুজোর মাধ্যমে তাঁদের অস্তিত্বকে জানান দেন এবং এই নতুন ভূখণ্ডকে আপন করে নেওয়ার ভাবনায় ক্যাপশন দেন– "বাড়ি ছাইড়া বাসাত আইলাম / বাসারে আমার ঘর বানাইলাম" । স্মৃতিকাতারতা আর বাস্তবতার স্বীকারোক্তি এই উচ্চারণ ।
যতটুকু জানা যায়, ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের কয়েকজন অধ্যাপক সম্মিলিত উদ্যোগে ব্যাঙ্গালুরুতে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সূচনা করেন । মূলত এই পুজো থেকেই বাঙালিরা এখানে নানা পুজোপার্বণ ও সামাজিক অনুষ্ঠান শুরু করেন । ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সের মাধ্যমে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন তার কাজ শুরু করে এখানে । তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । ব্যাঙ্গালুরুর নানা প্রান্তে শুরু হয় বাঙালিদের নানা সংগঠন, পুজো ও সামাজিক অনুষ্ঠান ।
কোলকাতা, আগরতলার পুজোতে যেমন দুর্গাপুজোর মন্ডপে ফুটে উঠে বিষয়ভাবনা তেমনি ব্যাঙ্গালোরের পুজোতেও জাঁকিয়ে বসেছে এই থিম । এখানে কদর রয়েছে থিম মেকারদেরও । পুজোর আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে থিম মেকার ও শিল্পীরা এসে মন্ডপ সাজিয়ে দেন । এখানে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের এবারের থিম শোভাবাজারের রাজবাড়ি । ১৭৫৭সালে ইংরেজদের হাতে শোভাবাজারের পতন ঘটার পর বিজয়োৎসবের আনন্দে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কোলকাতার শোভাবাজারের জমিদার নবকৃষ্ণ দেবের পুজোর মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা করা হয় । তাঁদের এবছরের মন্ডপ শোভাবাজারের রাজবাড়ির আদলে ।এবছর তাঁদের পুজো ৭৫ বছরে পড়ল ।
ব্যাঙ্গালুরুর প্রাচীন পুজোর মধ্যে এ বছর একাত্তরে পা দিল জয়মহল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপুজো । তাদের এ বছরের থিম হারিয়ে যাওয়া শৈশব ( Lost Childhood ) ।
আরটি নগর প্যালেস গ্রাউন্ডে কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের থিম 'মুক্তি' । মণ্ডপসজ্জায় রয়েছে বর্তমান জটিল জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতি । কর্পোরেট জীবন যেভাবে মানুষের ব্যক্তিগত সময়, আনন্দ, সুখ ও বিনোদনকে কেড়ে নিচ্ছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর্তি রয়েছে এই মন্ডপের ভিতরের শিল্পকলায় । এই চত্বরেরই আর একটি পুজো ব্যাঙ্গালুরু কালচারাল এসোসিয়েশন নারী ক্ষমতায়নের থিমকে মাথায় রেখে নারী জাতিকে সম্মান জানাতে পুজো পরিচালনা, পুরোহিত ও ঢাকের বাজনায় অংশ নিয়েছেন একদল মহিলা । গ্রীন গ্লেন লেআউট অ্যাসোসিয়েশনের এবারের পূজোর থিম 'নটরাজ' । বর্তমানে চলা সারা বিশ্বময় অস্থিরতা, ধ্বংস, তান্ডবকে মাথায় রেখে তাঁরা বিশ্ববাসীর কাছে এই সংকটময় মুহূর্ত থেকে পরিত্রাণের বার্তা পৌঁছে দিতে চান । নটরাজের তাণ্ডব হিংসার বিরুদ্ধে শান্তির জয়বার্তা ঘোষণা করছে । কোরমঙ্গলার সারথি সোসিও কালচারাল এর পুজোর ২৩ তম বছরের থিম 'মিলে সুর তুমহারা হামারা' । বেশ কিছু বছর আগে দূরদর্শনে বিভিন্ন ভাষায় এই গানটি প্রচারিত হত । সেই ভাবনাকে নিয়ে নানা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের সম্প্রীতির চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে । পূর্ব ব্যাঙ্গালোরে কেটিপিও গার্ডেনে পূর্বা ব্যাঙ্গালুরু কালচারাল এসোসিয়েশনের পুজোয় সাবেকিয়ানার ছাপ রয়েছে । বিশাল চত্বর নিয়ে তাঁদের পূজো মন্ডপে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় হচ্ছে । জনভোগের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে । বরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি তাঁদের যত্ন লক্ষণীয় ।
ইন্দিরানগর ঐক্যতান হেব্বেল কালচারাল সোসাইটি তাঁদের এবারের সাতান্নতম বর্ষের দুর্গোৎসবে দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাকে ভগবত গীতার মাধ্যমে তুলে ধরতে চান । তাঁরা মনে করেন গীতার বাণীর মাধ্যমে ব্যক্ত শিক্ষা বা বোধ আজকের দিনে খুবই অর্থবোধক যেখানে সম্প্রীতি ও শান্তি প্রশ্নের সম্মুখীন । মন্ডপসজ্জায় গীতা থেকে উদ্ধৃত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে সেই সময়ের পরিবেশকে স্পষ্ট করা হয়েছে । সারা প্যান্ডেল জুড়েই গীতার শ্লোকের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী দর্শকের সামনে মেলে ধরা হয়েছে । নেল্লুরহাল্লি, হোয়াইট ফিল্ড কালচারাল এসোসিয়েশন তাদের মন্ডপ করেছেন কেদারনাথ মন্দিরের আদলে । এরকম বিবিএসইটির এ বছরের থিম হল পশ্চিম ভারতের রাজকীয় রাজস্থান । রাজস্থানের ঐতিহ্য প্রাচীন দুর্গ ইত্যাদি প্রদর্শন রয়েছে এখানে । তেমনি পূর্ব ভারতকেও তুলে আনা হয়েছে ব্যাঙ্গালুরুর পূজামন্ডপে । সাউথ ইস্ট ব্যাঙ্গালুরু বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজোর থিম 'পুরাতন বাংলার রাজবাড়ীর দুর্গোৎসব' । নর্থ বেঙ্গালুরু কালচারাল সমিতি এ বছর তাঁদের আয়োজিত দুর্গোৎসবের থিম করেছেন ভারতের ধ্রুপদী ইনডোর গেম দাবাকে কেন্দ্র করে দাবার জগৎ ( World Of Chess ) । তাঁরা এবছর সমস্ত গ্র্যান্ড মাস্টারদের স্মরণ করতে চাইছেন । এই পুজোর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা দাবার ৬৪ ঘর বা ঘুঁটির সঙ্গে শক্তির ৬৪ রূপ, মায়ের ৬৪ যোগিনীর সম্পর্ক নির্ণয় করতে চাইছেন । তারা বলতে চাইছেন দাবা শক্তিরই অভিন্ন রূপ ।
No comments:
Post a Comment